শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য সাফল্যেরা পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত বিভূতি কার্যকর ছিল। সাহস তো অবশ্যই, তাঁর বুদ্ধিমত্তাও ছিল প্রখর। কখন কোন আওয়াজটা তুলতে হবে, তুললে মানুষ সাড়া দেবে সেটা তিনি জানতেন। আপস করতেন না। মানুষ চিনবার ক্ষমতা তাঁর ছিল অতুলনীয়। ছাত্র ও যুবকদের তিনি যে অমনভাবে কাছে টেনে নিতে পারতেন এর কারণ ছিল নেতৃত্বদানে তাঁর ক্ষমতা। কাকে দিয়ে কোন কাজ হবে সেটা তিনি বুঝতেন। আগরতলা মামলার সময়ে তাঁর মুক্তির দাবিতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন করছে সেটা তাঁর অজানা থাকবার কথা নয়; কিন্তু তিনি জানতেন এ আন্দোলনকে পূর্ণতা দেবার জন্য একজনকে খুব দরকার, তিনি হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। সামরিক আদালত থেকে সাংবাদিক আতাউস সামাদের মারফত মওলানার কাছে তিনি বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাঁর মুক্তির জন্য আন্দোলনের অনুরোধ জানিয়ে।
সংক্ষিপ্ত বার্তাটিতে তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য তাঁকে মওলানার দরকার হবে, এবং তাঁরও দরকার হবে মওলানাকে। মওলানা বুঝি এই রকমের একটি বার্তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবেই তিনি ঘোষণা দেন, ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টনে জনসভা হবে মুজিবের মুক্তির দাবিতে। সেই জনসভাতে মওলানা যে অনলবর্ষী বক্তৃতা দেন তাতে মানুষ যেমন উদ্বুদ্ধ হয়েছে, তেমনি ভয় পেয়ে গেছে শাসকরা। তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হবে, জেলের তালা ভাঙা হবে, বাস্তিলের দুর্গের মতো পতন ঘটবে সামরিক কারাগারের। সমাবেশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী আওয়াজ উঠেছিল ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ এরপর অবশ্যম্ভাবী ছিল যে, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হবে এবং মামলার সকল অভিযুক্ত তো বটেই, অন্য রাজবন্দিরাও মুক্তি পাবেন।

রাজনীতিতে শেখ মুজিব দু’জনকে অগ্রপথিক ও পথনির্দেশক হিসেবে পেয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। শুরুতে তাঁরাও জাতীয়তাবাদী নেতাই ছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। পরে তাঁরা পৃথক হয়ে যান এবং সেটা ঘটে ওই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই। সোহরাওয়ার্দী শুরুতে যেমন, শেষ পর্যন্তও তেমনি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; ভাসানী যা ছিলেন না। ভাসানী বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই। মুজিবও তাই। তবে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মুজিবের বিচ্ছেদ ঘটেনি, বিচ্ছেদ বরং ঘটেছে ভাসানীর সঙ্গেই; সেই ১৯৫৭ সালে, ভাসানী যখন ন্যাপ গঠনের উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বের হয়ে যান তখন। এর কারণ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ভাসানী সমাজতন্ত্রমুখী করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন; মুজিব অতটা যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। সমাজতন্ত্র ছাড়া যে উপায় নেই, এটা তিনি জানতেন এবং মানতেনও; কিন্তু তাঁর পক্ষে কমিউনিস্ট হওয়া, এমনকি কমিউনিস্টদের সহযাত্রী হওয়া সম্ভব ছিল না, যেটা তিনি নিজেও বলেছেন। আগে বলেছেন সমবয়সী রাজনীতিকদের, স্বাধীনতার পরে বলেছেন সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিতে উদ্যত তাঁর অনুসারীদের।

বাঙালিকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করাটাই তাঁর জন্য প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর জীবিত অবস্থাতেই তিনি পথের সন্ধান করছিলেন। নিজের হাতে ইশতেহার লিখে ও ছাপিয়ে গোপনে বিলির বন্দোবস্ত করেছেন। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, আইয়ুববিরোধী যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করবার জন্য। আগরতলাতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের দুঃসাহসিক ও বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেনাছাউনিতে যে বাঙালিরা বিদ্রোহের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের উৎসাহিতও করেছেন। উনসত্তরের অভ্যুত্থানের পরে লন্ডনে গেছেন, একটা উদ্দেশ্য সাহায্যের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ তাদের নিজেদের জন্য একজন নেতা খুঁজছিল। সে নেতাকে তারা পেয়ে গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে; আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, ভাষার ব্যবহার– সবদিক দিয়েই তিনি কেবল যে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি ছিলেন তা নয়, মেহনতি মানুষও তাঁকে প্রিয়জন মনে করতেন, তিনিও তাঁদের আপনজন হিসেবে দেখতেন। তাঁর প্রিয় উক্তি ছিল, ‘দেশের মানুষকে আমি ভালোবাসি এবং দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে।’ তবে মধ্যবিত্তই তাঁকে পেয়ে বিশেষভাবে খুশি হয়েছে এবং তাঁর ওপর ভরসা করেছে। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকদের জন্য তাঁর ছয় দফা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি টাইম বোমা; তাদের শঙ্কা ছিল যে ওটি বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে এবং সেটির বিস্ফোরণও ঘটেছিল বৈকি সত্তরের নির্বাচনে। ওই বিস্ফোরণের পরে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে অর্বাচীন পাকিস্তানি সশস্ত্র জেনারেলরা গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।(সৌজন্যে:দৈনিকসমকাল)