জাফলং ও উৎমাছড়ায় পর্যটকদের হেনস্তা কেন?
প্রান্তডেস্ক: ঈদের ছুটিতে সিলেটে বেড়াতে এসে হেনস্তার শিকার হয়েছেন পর্যটকরা। একদিনের ব্যবধানে জাফলংয়ে পর্যটকদের উপর হামলা ও কোম্পানীগঞ্জে পর্যটনকেন্দ্র থেকে পর্যটকদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
হেনস্তার ক্ষেত্রে পর্যটকদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতা ও পরিবেশ নষ্টের অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও স্থানীয় একটি অংশের অভিযোগ, নির্বিঘ্নে চোরাচালান ও পাথর লুট করতেই পর্যটকদের বাধা দেয়া হচ্ছে। পর্যটক সমাগম বাড়লে লুটপাট ও চোরাকারবারে সমস্যা হয়। তাই পর্যটকদের আসতে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
এদিকে, আশ্লীলতার অভিযোগ এনে সোমবার রাতে মৌলভীবাজারের রাজনগরে ‘রাজনগর রিসোর্ট এন্ড কফি হাউজে’ তালা দিয়েছে স্থানীয় একদল লোক। এসময় স্থানীয় থানার পুলিশ সদস্যদেরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।
সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুটি স্থান জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জ। সবসময়ই এই দুই এলাকায় পর্যটকদের ভিড় থাকে। ঈদের মতো বড় ছুটিতে ভিড় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সীমান্তবর্তী এই দুই এলাকা দিয়েই ভারত থেকে দেদারছে চোরাই পণ্য আসে। এছাড়া এসব এলাকার পাথুরে নদী ও ছড়া থেকে পাথর লুটপাটও নিত্তকার ঘটনা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর চোরাচালান ও পাথর লুট অনেকটা বেড়ে গেছে। প্রশাসনও লুটপাটকারী ও চোরাকারবারীদের ঠেকাতে পারছে না।
জানা যায়, ঈদের পরদিন রোববার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের পাহাড় থেকে নেমে আসা পাথুরে ছড়া উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্রে ভিড় করেন অনেক পর্যটক । বিকেলে সেখানে কিছু সংখ্যক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কিছু লোক জড়ো হয়ে পর্যটকদের বের করে দেয়। এরকম একটি ভিডিও সোমবার রাত থেকে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
জড়ো হওয়া যুবকরা পর্যটকদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতা, মদ্যপান ও এলাকার পরিবেশ নষ্টের অভিযোগ করেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পর্যটকদের বের করে দেয়ার একটি ভিডিওতে এক যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘এই এলাকা আলিমদের এলাকা, দ্বীনদার এলাকা। কিন্তু এইখানে অনেকে অনেক পরিবেশে আসে। এসে মদ খায়, আরও অনেককিছু করে, এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়। তাই আমাদের আবেদন, আপনারা এখানে আর আসবেন না। তাছাড়া এটি পর্যটনভুক্ত এলাকাও নয়’।
ভিডিওতে আরও বলতে শোনা যায়, এই এলাকার আলেম-ওলামা ও স্থানীয়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে উৎমাছড়াকে পর্যটন করা যাবে না। তাই আপনারা যারা এখানে এসেছেন দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আপনারা এখানে থেকে এখানের পরিবেশ নষ্ট করবেন না। এই এলাকার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য আমরা এখানে পর্যটকদের আসতে নিরুৎসাহিত করছি আজকের পর আপনারা এখানে আর কোনদিন আসবেন না।
তবে পর্যটকদের বের করে দেয়ার এই ভিডিও যুক্ত করে পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ফেসবুকে লিখেন, একদিকে চলবে পর্যটক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা অন্যদিকে পর্যটনে বাঁধা! দেশের ভেতরে সরকার ঘোষিত কোন সংরক্ষিত এলাকা ও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মালিকানাধীন জায়গা ব্যতীত কোথাও জনসাধারণের প্রবেশে বাঁধা দেয়া মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। মানুষের চলাচলে বাঁধা প্রদান ও হুমকি প্রদান দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সিলেটে এই অপরাধ ইতিপূর্বেও ঘটেছে।
কিম লিখেন, ‘বছর কয়েক পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলায় এক ঈদে মায়াবন নামে পরিচিত যুগীরকান্দি জলারবনে পর্যটকদের উপর হামলা করা হয়েছিল। এরপর থেকে ওই বনে কোন পর্যটক আর পা রাখেনি। স্থানীয় মাদ্রাসা ওই জলার বনের মাছ ভোগ করে বলে এখানে পর্যটক আসুক তা চায় না। অশ্লীলতার দোহাই দিয়ে যুগীরকান্দি বন বা মায়াবন সবার দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়। উতমাছড়ার পাথর লুটে এই মাদ্রাসার সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা জানা প্রয়োজন।’
তিনি আরও লিখেন, ‘এই মোল্লাদের চোখের সামনে দিয়েই ভারত থেকে চোরাচালান হয়ে মাদকদ্রব্য আসে। আজ পর্যন্ত দেখলাম না সীমান্তবর্তী এলাকার কোন মাদ্রাসার তালেবরেরা চোরাচালান বন্ধে এমন কিছু করেছে। ভারতীয় চোরাই পণ্য ও মাদক প্রবেশ করে আলিম উলামাদের এই পবিত্র এলাকা দিয়েই। ধর্মকে এরা তামাশায় পরিণত করেছে।’
এব্যাপারে আব্দুল করিম কিম মঙ্গলবার বলেন, আলিম-উলামার এলাকা দিয়ে মাদক চোরাচালানে সমস্যা নেই। নারী বারকি শ্রমিকের ভেজা শরীরে পাথর তোলায় আপত্তি নেই। আল্লাহর সৃষ্টি পাহাড় নদী ধ্বংস করে পাথর-বালি উত্তোলনে সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু পর্যটকে কেন? তার অশ্লীলতা অজুহাত মাত্র। এর নেপথ্যে অন্যকিছু রয়েছে।
এ ঘটনা প্রসঙ্গে কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সুমন মঙ্গলবার ফেসবুকে লিখেন- ‘দিনে রাতে উৎমাছড়া থেকে পাথর লুট করছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। সাহস থাকলে তাদের একটি গাড়ি আটকিয়ে দেখান আমরা আপনাদের পক্ষে থাকবো।’
উতমাছড়ায় পর্যটকদের বের করে দেয়ার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন যুব জমিয়ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি মুফতি রুহুল আমিন সিরাজী। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, পর্যটনের নামে কিছু মানুষ এখানে এসে মদ্যপানসহ অশ্লীল কার্যক্রম করে যার ফলে আমাদের এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। যুব সমাজ এসব কার্যক্রম দেখে বিপদমুখী হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে স্থানীয় আলেম-ওলামা মুরুব্বি ও যুবকদের নিয়ে ঈদের আগের দিন বসে মিটিং এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়েছে- এই পর্যটন স্পটটিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই কারণেই আমরা রবিবার বিকালে পর্যটকদেরকে সম্মানের সাথে বুঝিয়ে বলেছি উৎমছড়ায় আর না আসতে।
উৎমাছড়ায় পর্যটকদের বাধা প্রদানকারীদের সাথে মঙ্গলবার বিকেলে বৈঠকে বসে উপজেলা প্রশাসন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, পর্যটকদের উৎমাছড়ায় যেতে বাধা দেওয়া ব্যক্তিরা স্থানীয় যুবসমাজ পরিচয়ে সেখানে যান। পর্যটকদের বাধা কিংবা নিষেধ করা হয়নি বলে বৈঠকে দাবি করেন তারা। তাদের দাবি, শহরের পোশাকের সঙ্গে গ্রাম এলাকার পোশাক সামঞ্জস্য নয়। যারা বেড়াতে যান তাঁদের পোশাক ‘শালীন’ রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুব জমিয়তের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুহুল আমিন সিরাজী।
প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান হয়েছে ও ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের একটি টিম গিয়েছিলাম সেখানে ধর্মের দাওয়াত দেয়ার জন্য। আমাদের এক ভাই ভুলে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধের কথা বলেছে। পর্যটক আসবে, আমাদের আপত্তি নেই।
সিরাজী বলেন, অনেক সময় পর্যটকরা আসা যাওয়ার সময় উচ্চ শব্দে গানবাজনা করেন যেটি এলাকার মানুষের কাছে বিরক্তিকর।
বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, পর্যটনকেন্দ্রে যেতে স্থানীয় লোকজন বাধা দিতে পারেন না। পর্যটকেরা কোনো অন্যায় কিংবা বেআইনি কাজ করলে স্থানীয় প্রাশাসনকে জানাতে হবে। পর্যটকদের নিয়ে নিজেদের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই—বৈঠকে এমনটি বুঝিয়ে বলা হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ বলেন, উৎমাছড়ায় বেড়াতে যাওয়া জন্য নির্দিষ্ট কিংবা উপযুক্ত রাস্তা নেই। এ জন্য পর্যটকেরা স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িঘর মাড়িয়ে যাতায়াত করেন। এতে তারা অসুবিধায় পড়েন। বৈঠকে এমন দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকায় মাদক সেবন ও অশ্লীলতা হয়, এমনটিও দাবি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের বলা হয়েছে, অবৈধ কোনো কিছু করে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা প্রশাসনকে জানাতে। আর পর্যটকদের বাধা না দিতে।
কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার বলেন, বৈঠকে যেসব কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর কথাবার্তার মিল নেই। এ জন্য তিনি স্থানীয় আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে মঙ্গলবার বিকেলে উৎমাছড়া এলাকায় গেছেন।
উৎমাছড়ায় পর্যটকদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, এ অঞ্চলে এমন ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি। বিষয়টি ইউএনওকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তিনি তদন্ত করে দেখছেন। ইউএনও জানার চেষ্টা করছেন, বিষয়টি কী?
তিনি বলেন, ‘এটা কে করল, কারা করল, কেন করল, সেটা আজকের মধ্যেই ইউএনও তদন্ত করে বের করবেন। এরপর যদি আইনি ব্যবস্থা নিতে হয়, তা-ও নেওয়া হবে।’
পর্যটকেরা কি নির্বিঘ্নে উৎমাছড়ায় যেতে পারছেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সবাই সেখানে আগের মতোই যেতে পারবেন। পর্যটক তো যাচ্ছেন, তা তো বন্ধ নেই। কেউ নিষেধ করতে পারবেন না। যে বা যারাই নিষেধ করবেন, তাদের বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া পর্যটকদের সুবিধার্থে উৎমাছড়ায় স্থানীয় প্রশাসন সব ধরনের নজরদারিও বাড়িয়েছে।’
এদিকে, সিলেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে পর্যটকদের উপর হামলা চালিয়েছে স্থানীয় কিছু লোক। হামলাকারীরা চোরাকারবারের সাথে সম্পৃক্ত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সোমবার বিকেলে জাফলং বিজিবি ক্যাম্প–সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, স্থানীয় কয়েকজন চোরাকারবারী চোরাই পথে আনা মাদক নিয়ে যাচ্ছিলেন। বিজিবি সদস্যরা তাদের দেখতে পেয়ে ধাওয়া দেন। এসময় বেড়াতে আসা কয়েকজন পর্যটক ওই চোরাকারবারীরা পালিয়ে কোন দিকে গেছে তা দেখিয়ে দেন। যদিও বিজিবি সদস্যরা তাদের আর খুঁজে পায়নি। এরকিছুক্ষণ পর বিজিবিকে তথ্য প্রদানকারী পর্যটকদের ওপর হামলা চালায় একদল লোক। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে স্থানীয় কয়েকজন মিলে বিষয়টি দ্রুত মীমাংসা করে দেন।
এ বিষয়ে গোয়াইনঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কবির হোসেন বলেন, স্থানীয় বখাটেরা পর্যটকদের ওপর হামলা করেছে। পরে সাংবাদিক ও ইউপি সদস্য মিলে ঘটনাস্থলেই বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছেন।(সৌজন্যে:সিলেট-টু-ডে২৪)