বাংলাদেশি গল্পকার ও ঔপন্যাসিকশহীদুল জহির’রমৃত্যু দিন আজ
প্রান্তডেস্ক:শহীদুল জহির (শুনুন, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ – ২৩ মার্চ ২০০৮) ছিলেন বাংলাদেশি ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, এবং সরকারি ঊর্ধ্বতন আমলা। তিনি বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার অন্যতম প্রবর্তকএবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে বিবেচিত হন। স্বকীয় ভাষাবিন্যাস এবং রীতি-ব্যবহার করে গল্প বলার নয়াকৌশলের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তিনি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যোগ করেছেন স্বতন্ত্র রীতি-পদ্ধতি, যা “শহীদুল জহিরীয়”ধারা বা প্রবণতা হিসেবে পরিচিত।
জহির পুরান ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন এবং শৈশবের আধিকাংশ কাটান সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ আর ঢাকায়। তেইশ বছর বয়সে তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তার “ভালবাসা” গল্পটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৯৯১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রে যান। ১৯৮১ সাল থেকে প্রায় তিন দশক তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত ছিলেন। জহির ছিলেন চিরকুমার। ২০০৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় ঢাকায় তার মৃত্যু হয়।
জহিরের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য স্বদেশ, রাজনৈতিক, এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তার ৭টি উপন্যাস, ৩টি ছোটগল্প সংকলন এবং ২টি গল্প সংকলন, ২টি উপন্যাস সংকলন, ১টি রচনাসমগ্র এবং ১টি অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত সংকলন, তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ২৭টি ছোটগল্প। বাংলা ছোটগল্পে তিনি যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা। তার গল্প সংকলন পারাপার (১৯৮৫), ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প (২০০০), এবং ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪)। তার রচিত গল্পসমূহ ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং বিশ্লেষিত হয়েছে। “ভালবাসা” (১৯৮৫), “পারাপার” (১৯৮৫), “আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই” (২০০০), “কাঠুরে ও দাঁড়কাক” (১৯৯২), “ডুমুরখেকো মানুষ” (২০০০), “এই সময়” (২০০০), “কাঁটা” (২০০০), “চতুর্থ মাত্রা” (২০০০), “কোথায় পাব তারে” (২০০৪), “ডলু নদীর হাওয়া” (২০০৪) প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য গল্প। জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮) তার জাদুবাস্তবতাবাদী রচনার অন্যতম সংযোজন, যেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দলিল হিসাবে বিবেচিত। মৃত্যের পর প্রকাশিত তার সর্বশেষ উপন্যাস আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু (২০০৯), প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৫ পুরস্কার লাভ করে। এছাড়াও সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (১৯৯৫) এবং মুখের দিকে দেখি (২০০৬) উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন বলে বিবেচিত হয়।
জীবদ্দশায় সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং কাগজ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার সাহিত্যচর্চার বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। তার রচনা একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে, তার সৃষ্টিকর্মের অভিযোজনে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ও মঞ্চনাটক।
প্রথম জীবন
শহীদুল জহির ১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভূতের গলিতে (ভজহরি সাহা স্ট্রিট) জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তার নাম ছিল মোহাম্মদ শহীদুল হক।তার পিতা এ কে নুরুল হক ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা জাহানারা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তার চার ভাই ও চার বোন ছিল এবং তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার হাশিল গ্রামে। তার দাদা জহিরউদ্দিন ছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তার দাদির নাম ছিল জিন্নাতুন নেসা। শহীদুল তার নামের জহির অংশটি তার দাদার নাম থেকে নিয়েছিলেন। জহিরের পিতার শৈশবে, জহিরের দাদা মারা যান। তার নানা ছিলেন সিরাজগঞ্জের আমলাপাড়ার আজিমুদ্দিন আহমেদ ও নানি হামিদা বেগম। ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কেটেছে। এসব স্থান ও স্থানীয় মানুষের ভাষা ও জীবনাচার রয়েছে তার লেখায়।১৯৯০ সালে তার বাবা মারা যান।
শিক্ষাজীবন
১৯৫৭ সাল পর্যন্ত জহির পিতার কর্মস্থলের কারণে কুমিল্লার চাঁদপুরে কাটান। সে বছরই তিনি পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ফিরে আসেন। জহিরের শিক্ষাজীবনের শুরু ঢাকার র্যঙ্কিক স্ট্রিটের সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। সেখানে তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত শিক্ষাজীবনের প্রথম চার বছর অধ্যয়ন করেন।১৯৬২ সালে ভর্তি হন নারিন্দার সেন্ট যোসেফ টেকনিক্যাল বিদ্যালয়ে স্কুলে। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তার জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮) উপন্যাসে এই সিলভারডেল ও কলেজিয়েট স্কুলে কথা রয়েছে। এরপর ঢাকার বাইরে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পড়েছেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া হাই স্কুলে। পরবর্তী বছর, অষ্টম শ্রেণীতে জহির চট্টগ্রামে চলে আসেন। সেখানে তিনি সাতকানিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে মানবিক বিভাগ থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমানে এসএসসি) সম্পন্ন করেন। ১৯৭৯ সালে কিছুকাল পিতার কর্মস্থলের কারণে সিলেটের মাধবপুরে কাটান। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার জন্য জহির পুনরায় ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকবর্ষে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭৬ সালে স্নাতক এবং ১৯৭৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা থেকে ফরাসি ভাষা বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের আগস্টে তিনি মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ডি.সি.র আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে যান। সেখানে তিনি ১৯৯২ সালের জুনে নন-ডিগ্রি সার্টিফিকেট ইন প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিগ্রি নেন। ২০০১ সালের জুনে তিনি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছিলেন।
কর্মজীবন
১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি জহির বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদান করেন। সেখানে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে তিন বছর কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও পরিবহন বিভাগে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস সহকারী সচিব পদে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব পদে যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে সহকারী সচিব পদে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সাভারের বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উপ-পরিচালক পদেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি।পরবর্তীতে ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব, এবং পুনরায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে উপসচিব হিসেবে ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দ্বায়িত্ব পালন করেন। সে বছরই জহির বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সময়কালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপসচিব হিসেবে নিযোগ পান। ২০০৩ থেকে পরবর্তী দুই বছর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে যুগ্ম সচিব হিসেবে ছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে যোগ দেন জহির। পরবর্তীতে জীবন বীমা কর্পোরেশনে তিনি প্রধান বীমা নিয়ন্ত্রক পদে কিছুকাল কাজ করেন। একই বছরের শেষের দিকে তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে নিযুক্ত ছিলেন অতিরিক্ত সচিব পদে।২০০৮ সালে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদে নিযুক্ত ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও মৃত্যু
শহীদুল জহির ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন নিভৃতিচারী। তিনি ছিলেন চিরকুমার। কথা ম্যাগাজিনের সম্পাদক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি এটি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম, “এটা বলতে পারব না। এটা এরকম হয়া গেছে।… আপনে শরীরে আগুন বয়া বেড়াবেন। আর লোকেরা আপনের দিকে তাকায়া ভাবতে থাকবে, কি জানি করতাছে।” তিনি কম কথা বলতেন এবং অন্তর্মুখী ছিলেন। তার সাথে বন্ধুত্ব করা কঠিন ছিল তবে তিনি অনেক বন্ধুসুলভ ছিলেন। বাংলাদেশী কবি ও কলামলেখক সমুদ্র গুপ্ত তার চাচাতো ভাই।
২০০৮ সালের ২১ মার্চ দুপুরনাগাদ অসুস্থতাজনিত কারণে জহির ইস্কাটনের হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে তাকে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২৩ মার্চ তিনি মারা যান। তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সামধিস্থ করা হয়।জহির কিছুকাল ঢাকার বেইলি রোডের সরকারি কলোনিতে বাস করেছেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঢাকার গ্রিন রোড গেজেটেড অফিসার্স ব্যাচেলর হোস্টেল বাস করতেন।
সাহিত্যকর্ম
শহীদুল জহির ছিলেন মূলত গল্পকার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে তেইশ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেলেও,আশির দশকে তিনি পুরোপুরি সক্রিয় হন। প্রায় তিন দশক লেখালেখি করলেও তার রচনার সংখ্যা সেই তুলনায় বেশি নয়।নিজেকে তিনি ‘ডিমান্ডিং লেখক’ হিসেবে দাবি করতেন। তার প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ৭টি। একাধিক ভাষায় তার রচনা অনুদিত হয়েছে।তার গল্প-উপন্যাসে রাজাকার ও সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর কদর্য নৃশংস চিত্র ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। তার প্রতিটি রচনায় ঘনিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে জীবনবোধ।
ছোটগল্প
তেইশ বছর বয়সে১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তার প্রথম গল্প “ভালবাসা” প্রকাশিত হয়, যেখানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রভাব স্পষ্ট।তার দ্বিতীয় প্রকাশিত গল্প ছিল “তোরাব সেখ”, সেটিও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়।১৯৮৫ সালে বত্রিশ বছর বয়সে তার প্রথম গল্পসংকলন পারাপার প্রকাশিত হয়।তিনি স্বীকার করেছেন যে, দুইজন সমসাময়িক ঔপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দ্বারা তিনি প্রভাবিত। তার প্রথমদিককার রচিত কিছু গল্পের কাহিনী মার্ক্সবাদের প্রভাব বহন করে। তার ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় জাদুবাস্তবতার তাত্বিক ধারণার বিকাশ লাভ করে। তার “কাঁটা” (১৯৯৫), “মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা” (২০০০) এবং “ইন্দুর-বিলাই খেলা” (২০০২) গল্পগুলিতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার ভাবনা, জিজ্ঞাসা ও শিল্পাভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। “কাঠুরে ও দাঁড়কাক” (১৯৯২) গল্প এবং আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু (২০০৯) উপন্যাসে তার এরশাদবিরোধীতা দেখা যায়। জহিরের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে ভিন্ন ধারা যুক্ত করেছে। অধিকাংশ গল্পের পটভূমিতে রয়েছে পুরান ঢাকার ভূতের গলি, ঘুরেফিরে এসেছে সেখানকার মানুষের চালচিত্র। তার গল্পের চরিত্রগুলোর অদ্ভুত-উদ্ভট-রহস্যময় কাণ্ড-কীর্তি একধরনের বিমূঢ় অনুভূতি সৃষ্টি করে। বাচিক গল্প, লোককথা, রূপকথা, লোকশ্রুতি, ধাঁধা, উদ্ভট ব্যাখ্যাহীনতা, পরাবাস্তবতা, রহস্যময় অধিবিদ্যা, গোলকধাঁধা ইত্যাদি জহিরের গল্পে বারবার পাওয়া যায়।তার “ডলু নদীর হাওয়া” (২০০৪) গল্পের চরিত্র তৈমুর আলি চৌধুরী একটি শর্ত বা চুক্তি মেনে নিয়ে মগকন্যা সমর্তবানু ওরফে এলাচিংকে বিয়ে করে। চুক্তিটি হলো, সমর্ত তাকে জহর (বিষ) দিয়ে মারবে। এখানে তিনি প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের পরস্পরবিরোধীতা দেখিয়েছেন।জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর তার সর্বমোট ২৭টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। “ভালবাসা” (১৯৮৫), “পারাপার” (১৯৮৫), “আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই” (১৯৯৯), “কাঠুরে ও দাঁড়কাক” (১৯৯৯), “ডুমুরখেকো মানুষ” (১৯৯৯), “এই সময়” (১৯৯৯), “আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস” (১৯৯৯), “চতুর্থ মাত্রা” (১৯৯৯), “কোথায় পাব তারে” (২০০৪), “ডলু নদীর হাওয়া” (২০০৪) প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য গল্প।
পারাপার
পরবর্তীতে নাম বদলালেও জন্মনাম শহীদুল হক নামেই প্রথম গ্রন্থ পারাপার লিখেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে জহির বলেন, সে সময়ে অন্য শহীদুল হক নামধারী লেখকদের সঙ্গে তার পরিচয়ে ভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছিল বলে তিনি নাম পরিবর্তন করেন। নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন,
দেখা গেলো যে, শহীদুল হক নামে লোকে আমাকে চিনতে পারছে না, আমার লেখা ছাপানোর পরেও ভাবছে যে, আমি, আমি না। কারণ, তখন অন্য একজন শহীদুল হক ছিলেন, টাইমসের সম্পাদক, লেখালেখি করতেন, আরেক জন আছেন শহীদুল হক খান। এদের দুই জনের সঙ্গে আমাকে প্রায়ই গুলায়া ফেলা হচ্ছিল। আমি বুঝলাম যে, এরা আমার সমস্যার জন্য নিশ্চয়ই তাদের নিজের নাম বদলাবেন না, আমি অখ্যাত, আমাকেই বদলাইতে হবে। জহিরউদ্দিন আমার দাদার নাম।
— শহীদুল জহির, কথা, সম্পাদক: কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
পারাপার শহিদুলের প্রথম গল্পগ্রন্থ, তার মতে যেটির গল্পগুলি অনেকটা প্রথাগত গঠনে লেখা, যার প্রতিটি গল্পে স্বাতন্ত্র্য স্বর-বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। কালি ও কলমর এক পর্যালোচনায় রীতি বা কাঠামোগত দিকের বিচার অনুমানে পারাপার আবদুল মান্নান সৈয়দের চলো যাই পরোক্ষে (১৯৭৩) গল্পগ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থে “পারাপার” শিরোনামে একটি গল্প রয়েছে। যেখানে প্রতীকীর মাধ্যমে শ্রেণিশত্রু নিপাতের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। তার প্রথম প্রকাশিত গল্প “ভালবাসা” এ গ্রন্থে যুক্ত হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে পুরোদস্ত্তর মনস্তাত্ত্বিক গল্প “মাটি ও মানুষের রং”। অন্যান্য গল্পের মধ্যে রয়েছে “তোরাব সেখ”, পুরান ঢাকার প্রেক্ষাপট রচিত “ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে”।
উপন্যাস
জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসের ১৯৮৭ সালের সংস্করণের প্রচ্ছদ, যেটির নকশা করেছিলেন শহীদুল জহির।
জহির সর্বমোট সাতটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে ৬টি জীবদ্দশায় এবং ১টি মরণোত্তর প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে ২টি জীবদ্দশায় অগ্রন্থিত হিসাবে প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৮৩ সালে পূর্বাণী বোনাস সংখ্যায় উড়াল শিরোনামে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। পরবর্তী বছর ১৯৮৪ সালের ডিটেকটিভ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস চন্দন বনে। দুটি উপন্যাসই মরণোত্তর শহীদুল জহির উপন্যাসসমগ্র গ্রন্থে সংকলিত হলেও জীবদ্দশায় জহির এগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেননি। ১৯৮৮ সালে তার প্রথম উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এটি তার প্রথম উপন্যাস। যার উপজীব্য ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত। যেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে এনেছেন। বাংলা কথাসাহিত্যে ‘শহীদুল জহিরীয়’ ধারা নামে যে স্বতন্ত্র রীতি-পদ্ধতি তিনি যোগ করেছেন উপন্যাসটি সেই স্বতন্ত্র কথাসাহিত্যরীতির অনন্য সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাণ্ডবকাহিনির পাশাপাশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার দৃশ্যপট এই উপন্যাসে পাওয়া যায়। হাসান আজিজুল হক এটিকে প্রখর পরিণত লেখকের লেখা উপন্যাস বলে মন্তব্য করেছেন। ২০২২ সালে উপন্যাসটি লাইফ অ্যান্ড পলিটিক্যাল রিয়ালিটি: টু নভেলাস শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়। ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় উপন্যাস গ্রন্থ সে রাতে পূর্ণিমা ছিল প্রকাশিত হয়। পূর্বে এটি আবিদ আজাদের সম্পাদনায় শিল্পতরু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা আর বাঙালির জাতিসত্তার আখ্যান এটি। হাসান আজিজুল হক একে “এককথায় একটি চাঁদে-পাওয়া উপন্যাস” বলেছিলেন। এটি পরাবাস্তব উপন্যাস হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে।
২০০৬ সালে তার তৃতীয় উপন্যাস মুখের দিকে দেখি প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় প্রকাশিত এটি জহিরের সর্বশেষ উপন্যাস। উপন্যাসের এক চরিত্র মামুন মিঞা বালক বয়সে করাতকলে কাঠের ভূষি আনতে গিয়ে চোরাই সারের ট্রাকে করে চট্টগ্রামে পাচার হয়ে যায়। সেখানে শিশু আসমানতারার খরগোশ হিসেবে খাঁচায় বন্দী অবস্থায় তার অন্য জীবন শুরু হয়। একই সময়ে একই চরিত্র মামুন তার পুরান ঢাকার বাড়িতে ফিরে এসে তার স্বাভাবিক জীবন কাটাতে শুরু করে। ভিন্ন বাস্তবতায় একই ব্যক্তির দুটি সমান্তরাল জীবনের মধ্য দিয়ে সময় ক্ষেত্রের ইঙ্গিত রয়েছে এই উপন্যাসে। ২০২৩ সালে উপন্যাসটি আই সি দ্য ফেস: অ্যা নভেলা শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়। ২০০৯ সালে তার সর্বশেষ উপন্যাস আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু মরণোত্তর প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু ১৯৯১ সালের ৮ জুন নিপুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নাতিদীর্ঘ এই উপন্যাসের পটভূমি তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলের কাহিনির গভীর ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এবং মানবিক অভিজ্ঞতার ভাষ্য। উপন্যাসটি ২০০৯ সালে সৃজনশীল শাখায় প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার লাভ করে। ২০২২ সালে উপন্যাসটি লাইফ অ্যান্ড পলিটিক্যাল রিয়ালিটি: টু নভেলাস গ্রন্থে আবু ইব্রাহীম’স ডেথ শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়। জহিরের মৃত্যুর পর মেহেরনি নামে একটি অপ্রকাশিত উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
অনুবাদ ও অন্যান্য
তিনি নিজের কিছু রচনা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। পাশাপাশি ইংরেজি ও বাংলা ভাষা থেকে তিনি কয়েকটি গল্প আনুবাদ করেছিলেন, যেগুলির মধে রয়েছে গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো রচিত “ফেরা”হোর্হে লুইস বোর্হেস রচিত “অযোগ্য বন্ধু” চিনুয়া আচেবে রচিত “ঔপনিবেশিক কমিশনার”, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে রচিত “আ ন্যাচারাল হিস্ট্রি অব দা ডেড” (১৯৩২),এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত “মুক্তি”।
কয়েকটি বাংলা কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, যার মধ্যে মোহাম্মদ সাদিক, আলতাফ হোসেন, কামাল চৌধুরীর কবিতা রয়েছে।এছাড়াও তার কিছু অপ্রকাশিত কবিতাও রয়েছে। তার একটি কবিতার একাংশ:
… তবুও আমরা আরও একবার সমবেত হলাম,
আর আমাদের সময়ের মাধ্যমে একটি কুঁড়ি ফুলে পরিণত হয়,
একটি রূপালি রূপচাঁদা নোনা পানিতে ভাসে …— শহীদুল জহির,
১৯৯৩ সালে লেখা “এই সময়” গল্পের একটি অসমাপ্ত চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি, তবে জীব্দদশায় তা অপ্রকাশিত ছিল। পরে সেটি অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত শহীদুল জহির (২০১৯) সংকলনে প্রকাশিত হয়। জহিরের কিছু অপ্রকাশিত চিঠি মৃত্যুুর পর বিভিন্ন সংকলন গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। সে সকল চিঠি থেকে ব্যক্তি জহিরের অচাঞ্চল্যকর চারিত্রিক বৈশিষ্ট ধরা পরে। কিছু চিঠিতে, বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে কাজ করা স্বত্তেও সে বিষয়ে তার নির্মোহ মূল্যায়ন নজরে আসে।
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে জহিরের ছোটগল্প কিংবা উপন্যাস অথবা উভয়ই পাঠ্য রয়েছে। তার সাহিত্য উচ্চতর পর্যায়ে গবেষণার বিষয়।
শৈলী
জহির মূলত একজন বাস্তববাদী লেখক। প্রবণতার দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধারাবাহিক তিনি।এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমার গল্প, বাংলা সাহিত্যে যে ঐতিহ্য আছে সেগুলি থেকেই আসা, এবং বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে আসতে পারে। এটা ওয়ালীউল্লাহও হতে পারে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবাদী সাহিত্যভাবনার তাৎপর্যমণ্ডিত রূপায়ণ ঘটেছে তার লেখনীতে। ইতোপূর্বে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের লেখায় তা দেখা যায়। জহির তার গল্পে এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছেন। তার লেখায় দেশ ও রাজনৈতিক চেতনার মধ্য দিয়ে জাদুবাস্তবতার রূপায়ণ-সংমিশ্রণ ঘটেছে। তার গল্প “পারাপার” (১৯৭৫), “ডুমুরখেকো মানুষ” (১৯৯২) এবং “ডলু নদীর হাওয়া’ (২০০৩) এবং উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮) ও সে রাতে পূর্ণিমা ছিল জাদুবাস্তবতাশ্রিত সাহিত্যধারার গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে বিবেচিত হয়। বলা হয় যে, লাতিন আমেরিকার লেখকদের লেখার জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া তার লেখায় রয়েছে। তিনি তার লেখায় ব্যাপারটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করেছেন। আহমাদ মোস্তফা কামালের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, জাদুবাস্তবতার ব্যাপারটা তিনি গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসের কাছ থেকে পেয়েছেন। তিনি অনেকের দ্বারা ‘‘বাংলার মার্কেজ’’ নামে অভিহিত হন। জাদুবাস্তবতার সঙ্গে তিনি রূপকথার আখ্যান নির্মাণে কথ্য ও মানভাষার মিশ্রণে স্বকীয় ভাষারীতি তৈরি করেছেন। অনেক সমালোচক জহিরের গল্পকে পরাবাস্তব গল্প হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও মোজাফ্ফর হোসেনের মতে জহিরের গল্পগুলো সম্পূর্ণ পরাবাস্তব গল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। পরবর্তীকালে এসব প্রভাব ছাপিয়ে তার গল্প বলার স্বতন্ত্রভাব “শহীদুল জহিরীয়” ধারা বা প্রবণতা হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।
ঐতিহ্যগত নির্মাণশশৈলীর বদলে ভিন্ন আখ্যানে তার গল্প বলার ধরনকে কিছুটা উত্তরকাঠামোবাদী বলা যেতে পারে।প্রচলিত কাঠামো ভাঙতে তিনি কিউবিজম, এবং কিছুক্ষেত্রে বিমূর্তন গঠনরীতি ব্যবহার করেছেন। এই গঠনরীতির কথা উল্লেখ করে জহির বলেছেন, মার্কেজের লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, এখানে চিত্রকল্পের ফর্ম আছে। পিকাসোর গের্নিকা যে ফর্মে আঁকা, এটা হচ্ছে কিউবিক ফর্ম। একটা জিনিস ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া আছে। তো সেই ছবিতে ঘোড়ার মাথা একদিকে, পা একদিকে; বিষয়টা হচ্ছে, ঘোড়াটা বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।…আমারও মনে হয়েছে লেখাগুলো যখন যেভাবে খুশি লেখা।
ভাষাগত দিকেও জহির তার স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন, কেননা পুরান ঢাকার ভাষাকেও তিনি হুবহু ব্যবহার করেননি তার লেখায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাব্যবহারেও তার পারদর্শিতা দেখা যায়। উল্লেখযোগ্যভাবে ডলু নদীর হাওয়া (২০০৩) গল্পে তার চাটগাঁইয়া ভাষার অসামান্য প্রয়োগ। তার গল্পের ভাব-বৈশিষ্ঠ প্রায়শই রাজনীতি-সচেতন। দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের সাহিত্যধারায় যে-ভাষাবিন্যাস নিবিড়ভাবে চলে এসেছে, জহিরের ভাষা তার থেকে ভিন্ন বা স্বতন্ত্র। যদিও কালি ও কলম পত্রিকার এক পর্যালোচনায় তার পারাপার সংকলনের গল্পে ভাষা-ব্যবহারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাষা-রীতির সাথে খানিকটা সাদৃশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও জহিরের নিজস্ব ভাষাবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার সমসাময়িক কোনো সাহিত্যিকদের সাথে সাদৃশ নেই।
রাজনৈতিক মতাদর্শ
শহীদুল জহিরের রাজনৈতিক দর্শন জটিল। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থন করতেন। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন তিনি।১৯৮৫ সালে প্রকাশিত পারাপার গ্রন্থের একাধিক গল্পে তার প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার ছাপ উঠে এসেছে। পারাপার-এর গল্পগুলিতে মার্কসীয় দর্শনের প্রভাব স্পষ্ট।তার অধিকাংশ লেখায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে তার গল্প “মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা” (২০০৪) এবং উপন্যাস উল্লেখযোগ্য। বিষেশত জিঞ্জিরা গণহত্যার বিষয় তার বিভিন্ন লেখায় বারবার পাওয়া যায়। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, জিঞ্জিরার ম্যাসাকারের কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার লেখায় বারবার জিঞ্জিরার কথা আসে।”
সমালোচনা
“হিসেব করে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় শহীদুল জহির কত আনার লেখক ছিলেন। তিন ভাগ অবাস্তব-বাস্তবকে মিলিয়ে যিনি সিকি ভাগ বাস্তবকে তীব্র তির্যক তীক্ষ্ণ করে তুলতে পেরেছিলেন, তিনি খুব সামান্য লেখক নিশ্চয়ই ছিলেন না।” |
—হাসান আজিজুল হক, দৈনিক সংবাদ |
১৯৮৫ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত জহিরের অভিষেক গল্প সংকলন পারাপার-এর অধিকাংশ গল্পের কাঠামোগত দিক বিচারে অনেকটা আবদুল মান্নান সৈয়দের ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত চলো যাই পরোক্ষে গল্পগ্রন্থের সঙ্গে মিল থাকলেও জহির এতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। তার ২০০৪ সালে প্রকাশিত ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দ মন্তব্য করেন: “ওয়ালীউল্লাহর প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে উপস্থিতি সত্বেও শহীদুল জহির নতুন কিছু করেছেন। এখানেই তার স্বকীয় কৃতিত্ব”।জহিরের গদ্যে সৈয়দ শামসুল হকের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও কমলকুমার মজুমদার, জেমস জয়েস ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রভাবও লক্ষনীয়। জহির সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে কবি ও সাহিত্য-গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন, “অনেকেই সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর ধারাবাহিকতায় পুষ্ট ও বর্ধিত। এদের মধ্যে সবচেয়ে যার লেখা আমাকে বিস্মিত ও আশান্বিত করেছিল তিনি হচ্ছেন শহীদুল জহির।“
সৃষ্টিকর্ম
শহীদুল জহীরের জীবদ্দশায় তিনটি উপন্যাস ও তিনটি গল্পসংগ্রহ এবং দুইটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তার মৃত্যুর পরবর্তী বছর ২০০৯ সালে সর্বশেষ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় প্রকাশিত তিনটি গল্পসংগ্রহে সর্বমোট ১৯টি গল্প রয়েছে, যেগুলি ১৯৭৪ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে রচিত। এর মধ্যে পুরান ঢাকার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৫ সালে রচিত “আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস” গল্পটি জহিরের ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প (১৯৯৯) এবং ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪) গল্পসংগ্রহে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও মৃত্যুর পর একাধিক সংকলন গ্রন্থে সর্বমোট সাতটি অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত গল্প প্রকাশিত হয়েছে।
অভিযোজন
শহীদুল জহিরের একাধিক গল্প অবলম্বনে মঞ্চনাটক, টেলিভিশন নাটক এবং স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার ১৯৯৩ সালে রচিত “এই সময়” (১৯৯৩) গল্পের উপর ভিত্তি করে ২০০২ সালে আশিক মোস্তফা ফুলকুমার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। একই গল্প থেকে নাটক নির্মাণ করেছেন ইকবাল খোরশেদ। গল্পটি ১৯৯৯ সালে “ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প” সংকলনে প্রকাশিত হয়। জহিরের ১৯৯৫ সালে রচিত মনোজগতের গল্প “কাঁটা” অবলম্বনে টোকন ঠাকুর একই শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। ১৯৮৫ সালে পারাপার সংকলনে প্রকাশিত ১৯৭৪ সালে রচিত জহিরের প্রথম গল্প “ভালবাসা” অবলম্বনে একই শিরোনামে ২০১৮ সালে শুভ্রা গোস্বামী একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন, যেখানে অভিনয়ে ছিলেন দীপক সুমন ও মৌসুমী হামিদ।] ১৯৯৮ সালে রচিত “চতুর্থ মাত্রা” গল্প থেকে ২০০১ সালে একই শিরোনামে নুরুল আলম আতিক টেলিভিশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
এছারাও “ভালবাসা” গল্প নিয়ে রেদওয়ান রনির নির্দেশনা ও ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর নাট্যরূপে নির্মিত হয়েছে টেলিভিশন নাটক ফুল। ১৯৯১ সালে রচিত “আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই” গল্প থেকে ২০১২ সালে টেলিভিশন নাটক নির্মাণ করেছেন জাহিন জামাল, যেটি চ্যানেল নাইনে প্রচারিত হয়েছিল। গল্পটি ১৯৯৯ সালের ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। জহিরের ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প বইয়ে সংকলিত, ১৯৯৯ সালে রচিত “কোথায় পাব তারে” গল্প অবলম্বনে দুটি নাটক নির্মিত হয়েছে। একটি দীপংকর দীপন পরিচালিত টেলিভিশন নাটক, যেটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন সারা জাকের। অন্যটি রচনা এবং পরিচালনা করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এছাড়াও কাঁটা গল্প অবলম্বনে ২০১০ সালে একটি টেলিভিশন চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন অনিমেষ আইচ।
১৯৯২ সালে রচিত “কাঠুরে ও দাঁড়কাক” গল্প থেকে দেশ নাট্যদল “জন্মে জন্মান্তর” নামে মঞ্চনাটকও প্রযোজনা করেছে। এছাড়াও তার ১৯৯৫ সালের সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাস থেকে রেজা আরিফের নির্দেশনায় একই শিরোনামে ২০১৩ সালে মঞ্চনাটক প্রযোজনা করেছে নাট্যদল আরশীনগর।] জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাস ভিত্তিক একই শিরোনামে ২০১৯ সালে সৈয়দ জামিল আহমেদ একটি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দেন। ২০২২ সালে “কোথায় পাব তারে” গল্প অবলম্বনে মো. আশরাফুল ইসলামের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় একই শিরোনামে একটি মঞ্চ নাটক পরিবেশিত হয়।
পুরস্কার
পুরস্কার | অনুষ্ঠানের তারিখ | বিভাগ/শাখা | কাজের শিরোনাম | সূত্র |
---|---|---|---|---|
আলাওল সাহিত্য পুরস্কার | ২০০৪ | উপন্যাস | — | |
কাগজ সাহিত্য পুরস্কার | ২০০৪ | কথাসাহিত্য | ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪) | |
প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৫ | ২০১০ | সৃজনশীল শাখা | আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু (২০০৯) | মরণোত্তর[৩৪] |