মায়ানমারের বিদ্রোহীদের চীনের হুমকি, বিশ্বব্যাপী বিরল খনিজ সরবরাহ হুমকির মুখে?

প্রান্তডেস্ক:বিশ্বের ভারী ‘রেয়ার আর্থ’ বা বিরল খনিজ সরবরাহ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে মায়ানমারের উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে চীনের মদদপুষ্ট সামরিক জান্তা ও কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) মধ্যে চলমান এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ওপর।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের অংশ হিসেবে কেআইএ গত ডিসেম্বর থেকে বামো শহর দখলের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বামো শহরটি কাচিন রাজ্যের একটি কৌশলগত গ্যারিসন শহর। শহরটি চীন সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ভারী খনিজ—যেমন ডাইস্প্রোশিয়াম ও টারবিয়াম— এই কাচিন রাজ্যের খনিগুলো থেকে উত্তোলিত হয়। এই খনিজ চীনে রপ্তানি করে ইলেকট্রিক গাড়ি ও উইন্ড টারবাইনের জন্য ব্যবহৃত চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চীন এই খনিজ প্রক্রিয়াকরণে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
তবে সম্প্রতি চীন কেআইএর কাছে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে— যদি তারা বামো দখলের প্রচেষ্টা বন্ধ না করে, তাহলে কেআইএর নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে খনিজ ক্রয় বন্ধ করে দেবে।বিষয়টি ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্রের বরাতে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
মে মাসে এই হুমকি দেয় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা, এমন দাবি করেছেন এক কেআইএ কর্মকর্তা। চীনের এই অবস্থান তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার কৌশলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেআইএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চীন একদিকে বামো দখলের চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে কেআইএ কাচিন রাজ্যের প্রধান রেয়ার আর্থ অঞ্চল দখলে নেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রায় ১৫ হাজার সদস্যবিশিষ্ট কেআইএ হচ্ছে মায়ানমার অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তাদের আর্থিক উৎস স্থানীয় কর ও প্রাকৃতিক সম্পদ। তারা মনে করে, চীন শেষ পর্যন্ত খনিজের চাহিদার কারণে রপ্তানি বন্ধ করবে না।
মায়ানমারের রাজনৈতিক সংকট ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে আরো জটিল হয়েছে। বিক্ষোভ দমনের পর শুরু হয় দেশজুড়ে বিদ্রোহ। বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহীরা নিলেও চীনের চাপের মুখে তাদেরকে জান্তার সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে।
চীন ইতিমধ্যেই জান্তাকে যুদ্ধবিরতির জন্য রাজি করাতে ২০২৪ সালে লাশিও শহরে মধ্যস্থতা করে। একদিকে চীন কেআইএর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, আবার অন্যদিকে তারা জান্তাকে ড্রোন ও যুদ্ধবিমান সরবরাহ করছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাংক স্টিমসন সেন্টার।
বামোর যুদ্ধ: যুদ্ধবিমান বনাম বিদ্রোহী সেনা
কেআইএর দাবি অনুযায়ী, তারা বামোর বড় একটি অংশ দখল করেছে এবং সেনাবাহিনী এখন বিচ্ছিন্ন কয়েকটি স্থানে সীমাবদ্ধ। তবে জান্তা এখনো আকাশসীমার দখলে রয়েছে এবং বামো শহরে নিয়মিত বিমান হামলা চালিয়ে শহরের বড় অংশ ধ্বংস করেছে।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ন্যাথান রুজার স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে জানান, শহরের বেশিরভাগ ক্ষতিই বিমান হামলায় হয়েছে। কাচিন অধিকারকর্মী খন জা জানান, এসব হামলায় শিশুসহ বহু বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং স্কুল, ধর্মীয় স্থান ধ্বংস হয়েছে। তার নিজের বাড়িও ধ্বংস হয়েছে।
৫ হাজার কেআইএ যোদ্ধা ও মিত্ররা বামো অভিযান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এক কেআইএ কমান্ডার। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে বামো দখল করে জান্তার উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এ ঘটলে কাচিন রাজ্য থেকে জান্তার প্রভাব অনেকটাই কমে যাবে।
বিদ্রোহীরা মনে করে, পুরো কাচিন রাজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে এলে চীনের পক্ষে জান্তাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া কঠিন হবে এবং তখন তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে বাধ্য হবে। ইউকে-ভিত্তিক বেনচমার্ক মিনারেল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষক নেহা মুখার্জি জানান, ‘কাচিন থেকে বিরল খনিজ সরবরাহ বন্ধ হলে বছরের শেষে বৈশ্বিক বাজারে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।’
এর ফলে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে দাম আরো বেড়ে যেতে পারে। বামোর লড়াই এখন শুধু একটি শহরের দখল নিয়ে নয়, এটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক খনিজ বাজার, চীনের ভূরাজনীতি ও মায়ানমার গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু। যতদিন না চীনের চাহিদা আর বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছে, ততদিন এই সংঘর্ষ আরো তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র : রয়টার্স

