আজ শ্রীরামসী গনহত্য দিবস
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ আগস্ট, ২০২৫ ১:৫১ অপরাহ্ণ | সংবাদটি ৫৯ বার পঠিত
প্রান্তডেস্ক:স্বাধীনতার জন্য চরম উদগ্রীব ও উজ্জীবিত সবাই। দাসত্বের শৃঙ্খল মেনে না নেওয়ার পণ ছিল তাদের। তাদের বুকে লুকিয়েছিল স্বাধীনতার গেরিলা আগুন। এ কারণে একাত্তরের জনযুদ্ধে চরম মূল্য দিয়ে এলাকার দেশপ্রেমিক লোকজন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। শ্রীরামসি গ্রামের স্কুলঘরে শান্তি কমিটির সভা আহবান করে গ্রামবাসীর উপর বাধ্যতামূলক উপস্থিতির আদেশ জারি করেছিল পাকিস্তানীরা। সভায় বিলম্বে উপস্থিতিদের মধ্য থেকে বাছাই করে গ্রামের বুদ্ধিজীবি, চাকুরিজিবী, তরুণ ও ছাত্রসহ ১০৪ জনকে আলাদা করে হাত পা বেঁধে, ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গ্রামবাসীর রক্তে রাঙ্গা হয়ে ওঠে বর্ষার জলথৈথৈ রূপালি হাওর। হত্যাকান্ড দেখে আতঙ্কে গ্রামের নারী পুরুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। লাশ দাফনের কেউ ছিলনা। গণহত্যার পর লোকজন গ্রামে ফিরে দেখেন লাশ নিয়ে চারদিকে শকুন, শেয়াল আর জীবজন্তুর ওড়াউড়ি। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া মৃত্যুপুরীতে ফিরে পচা, অর্ধগলিত ও জীবজন্তু খাওয়া ৪/৫টি করে লাশ গর্তে মাটিচাপা দেন তারা। এত নৃশংসতা নরযজ্ঞ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন গ্রামের মানুষ।একাত্তরের ৩১ আগস্ট বর্ষার বৃষ্টিস্নাত সকালে সুনামগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংগঠিত হয় শ্রীরামসি গ্রামে। পরপর তিনদফা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ফিরে যাবার সময় নরপিশাচরা আগুনে ছারখার করে বাজার, বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা। বিবিসি বাংলা তখন এই গণহত্যার উপর বিশেষ সংবাদ প্রচার করে। গণহত্যাযঞ্জে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ক’জন এখনো স্মৃতি মনে করে হু হু করে কাঁদেন, নিরবে চোখের জল ফেলেন। নৃশংস বর্বতার নমুনা দেখে শিউরে ওঠা লোকজন এখনো দলাপাকানো ঘৃণা ছুড়ে দেন পাক বাহিনীর দেশীয় দোসর, আল বদর রাজাকারদের মুখে। এই ঘটনার পর থেকেই এলাকার অনেকেই পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে নরহত্যার প্রতিশোধ নিতে জন্মযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন।
নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শ্রীরামসী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জোয়াহির চৌধুরী (৭৬) এর সঙ্গে কথা হয় একাধিকবার। স্মতিচারণ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি তার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে ওঠে। ফ্যাকাশে হয়ে যায় চেহারা। কেমন নষ্টালজিকতা পেয়ে বসে তাকে নিরব-নিথর করে দেয়। কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকাল তাই চারদিকে থৈথৈ জল। স্থানীয় রাজাকার আহমদ আলী স্কুলের দু’জন ছাত্রকে বাহক করে শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়ে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিয়ে শান্তি কমিটির সভা আহবান করে। ধিরে ধিরে এলাকাবাসী জড়ো হতে থাকেন। পর্যাক্রমে শিক্ষক, সরকারি চাকুরিজীবি, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন জড়ো হন। তবে যারা দেরি করে বৈঠকে উপস্থিত হন তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তাদের মধ্য থেকেই বেশিরভাগকেই হত্যা করার জন্য বাছাই করা হয়। পাক দানবরা প্রথমে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিনকে লাঞ্চিত করেই বৈঠকে উপস্থিতিদের মধ্য থেকে ধড়পাকরের নির্দেশ দিয়ে এলোপাথারি মারধর শুরু করে। প্রথম দফায় প্রধান শিক্ষক, স্কুলের আরেক শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হাই, তহশিলদার, পোস্ট মাস্টারসহ ২৬ জনকে ব্রাশফায়ারের মুখে ফেলে। এই দলের ২৪ জন মারা যান। জোয়াহির চৌধুরী ও আলকাছ মিয়া নামের দুই তরুণ সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীতে নৌকায় তোলে আরো ৫০ জনকে এলোপাথারি গুলি করে হত্যা করে। যারা নৌকা থেকে প্রাণে রক্ষার জন্য পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তাদেরকেও উপরে তোলে আবার পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছুক্ষণ পরে আরেকটু দূরে গিয়ে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আরো ৩০ জনকে হাত পা বেঁধে ব্রাশফায়ারের মুখে হত্যা করা হয়। শান্তি কমিটির নির্দেশে গ্রামবাসীকে স্কুলে জড়ো হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো কোমলমতি শিক্ষার্থী আব্দুল মালিক ও তোফাজ্জল হককেও তারা রেহাই দেয়নি, গুলি করে হত্যা করে। পৈশাচিকতা চালিয়ে ফিরে যাবার আগে গ্রামের কিছু লোককে বাধ্য করে শ্রীরামসি বাজার পুড়িয়ে দিয়ে যায়।
একসঙ্গে নারকীয়ভাবে গ্রামের এত নীরিহ লোককে প্রকাশ্য হত্যা ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গ্রামের লোকজন প্রাণে বাঁচার ভয়ে স্বজনদের লাশ রেখে পালিয়ে যান। প্রায় এক সপ্তাহ গ্রামে শেয়াল কুকুর শকুন ছাড়া কোন জনমানব ছিলনা। সপ্তাহ খানেক পর গ্রামবাসী ফিরে এসে দেখেন লাশ নিয়ে শেয়াল কুকুর শকুনের কাড়াকাড়ি। চোখের জলে জীবজন্তু খাওয়া গলিত পচা লাশই এক একটি গর্তে ৪/৫ জন করে বিনা কাফনে দাফন করেন। শোকে কাতর স্বজনহারা গ্রামবাসী শপথ নেন স্বাধীনতার।
বেঁচে যাওয়া লোকজন ও গ্রামের প্রবীণ মুরব্বিরা এই নারকীয় হত্যার পিছনে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরা কয়েকটি কারণে ক্ষুব্দ ছিল বলে জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, ১৯৭০ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে টানানো তারকাখচিত পাকিস্তানী পতাকা তালেব হোসেনসহ কয়েকজন যুবক নিচে নামিয়ে পদদলিত করে স্বাধীন বাংলার স্লোগান দেন। এই খবরটি তখন স্থানীয় রাজারকার গোষ্টি পাকিস্তানী ‘একশন সেলে’ লিপিবদ্ধ করায়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দু’জন রাজাকার শান্তি কমিটির হয়ে চাঁদা ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য এলাকায় এলে তাদেরকে গণপিঠুনি দিয়ে বিদায় করে এলাকাবাসী। এই খবরটিও দেওয়া হয় পাকিস্তানী বাহিনীকে। এদিকে পাক বাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এই এলাকাকে নিরাপদ ভেবে পার্শবর্তী এলাকার প্রায় শতাধিক হিন্দু নারী পুরুষ গ্রামে আশ্রয় নেন। এই খবরটিও পৌঁছে দেয় রাজাকাররা পাক বাহিনীকে। এসব কারণে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী চরম ক্ষুব্দ ছিল শ্রীরামসি গ্রামবাসীর উপর। এসব কারণে ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সুনামগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংগঠিত হয় বলে মনে করা হয়।
সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের কয়েক জন হলেন ঃছাদ উদ্দিন আহমদ( ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, শ্রীরামসি উচ্চবিদ্যালয়) মৌলানা আব্দুল হাই(ওই বিযালয়ের হেড মৌলবী) এহিয়া চৌধুরী (তহসিলদার) সত্যেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী( তহসিলদার)সৈয়দ আশরাফ হোসেন( পোস্টমাষ্টার),শফিকুর রহমান,ফিরোজয়া, সুনুমিয়া।,আলা মিয়া,সমুজ মিয়া, নজীর মিয়া,মরম উল্লা,আব্দুল মান্নান,ওয়ারিছ মিয়া,মানিক মিয়া,আব্দুল জলিল,ছবির মিয়া,মমতাজ উল্লা,ছওয়াব উল্লা,রইছ উল্লা,আব্দুল মজিদ,আব্দুল লতিফ,একলাছ মিয়া,মোক্তার মিয়া,আব্দুল বারি,উছমত উল্লা,তৈয়ব উল্লা, বাক্কু মিয়া,মছদ্দর আলী,তফাজ্জল আলী,আছাব মিয়া,ছমির আলী,জহুর আলী, আব্দুল হান্নান প্রমুখ।বাকি নাম গুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বিদ্রঃ—-শহীদের নাম মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ ভাইয়ের “সিলেটে গনহত্যা” বই থেকে নেওয়া। আমি উনার কাছে কৃতজ্ঞ কারন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লিখতে গেলেই উনার বইযের, মৌকিক সাহায্য সব সময় পেয়ে থাকি। উনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার নেই। তাছাড়া মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্টি শ্রদ্ধেয় মফিদুল হক ভাই সহ যারাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেন সবার কাছ থেকে ঋন নিয়ে লিখি কারন মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা খুব ছোট ছিলাম, ফলে লিখতে গেলেই পূর্বসুরীদের শরনাপন্ন হতে হয় বিশেষত তাদের গবেষণা কাজের তাই আমি সবার কাছে ঋনী।

