বিভুরঞ্জন সরকার: এক নিঃসঙ্গ নীলকণ্ঠ পাখি

আশরাফুল আযম খান:গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের দুই কি তিন সপ্তাহ পর বিভুদাকে একটা শোয়ে গেস্ট হিসেবে এনেছিলাম। দেখলাম তিনি সেদিন কিছুটা বিমর্ষ। দাদাকে চিনি অনেক দিন থেকে। যখনই দেখেছি তাঁকে হাসিখুশি দেখেছি। প্রোগ শুরুর আগে জানতে চাইলাম, দাদা কেমন আছেন? জানালেন, ঔষধ আর অভাবের সাথে দোস্তি করে বেঁচে আছেন। শরীরটা ভালো যায় না এখন, মানসিক শক্তিতে চলছেন। তবে ক’দিন থেকে একটা উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটছে তাঁর। মেয়ে পিজিতে একটা উচ্চতর ডিগ্রির পরীক্ষা শেষ করে এসেছে, ফাইনাল প্রেজেন্টেশন বাকি। কিন্তু মেয়েকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে সে ফ্যাসিস্টের দোসর। তার পরীক্ষা নেওয়া না-ও হতে পারে। যদিও মেয়েটি ঘুণাক্ষরে কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে বা মিছিলে যায়নি। এ অবস্থায় মেয়েটা আদৌ তার ডিগ্রিটা শেষ করতে পারবে কি না? যেন তীরে এসে তরী ডুবে যাচ্ছে। এনিয়ে তাঁর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কথা শুনে আমি এর একটা সহজ সমাধান দিলাম। বললাম, বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা তো আপনার পরিচিত। তাঁকে জানালে তিনি এ বিষয়ে সহায়তা করতে পারেন। দাদা বললেন, দেখি কী করা যায়। কিছুতো একটা করতে হবে। মেয়েটা পরীক্ষা দিতে না পারলে মনে মনে মরে যাবে। সারাদিন নিখোঁজ সংবাদের অবসান ঘটিয়ে নতুন সংবাদ এলো, মুন্সিগঞ্জের মেঘনার স্রোতে ভাসতে দেখা গেছে বিভুদাকে। মৃত অবস্থায় তাঁর লাশ সনাক্ত করা গেছে। মৃত্যুর আগে লেখা খোলা চিঠিতে এটাও জানলাম, বিভুদার সেই বিসিএস পাশ ডাক্তার মেয়েটিকে পরীক্ষায় ফেল করে দেওয়া হয়েছে।
বিভুদা সর্বশেষ ৪ বছর আজকের পত্রিকায় ছিলেন। এই ৪ বছরে তাঁর প্রোমোশন হয়নি। বেতনও বাড়েনি। তার আগে অনেক বছর বেকার থাকতে হয়েছে বিভুদাকে। তখন মাঝেমধ্যে ফেসবুকে তাঁর বেকারত্ব, অভাব, অসহায়ত্বের কথা অকপটে তিনি লিখতেন। সে সময়টাতে এমনি এক টক শোর শুরুতে একদিন কথা হচ্ছিল, চাকুরি তিনি পাচ্ছেন না। চারিদিকে কত মিডিয়া, কত অনলাইন। কত ভুঁইকদম সাংবাদিকেরা ফুলে-ফেঁপে বড় হয়ে যাচ্ছে। শীর্ষে উঠছে। অথচ তিনি চাকরি পাচ্ছেন না। বড় সাংবাদিক পরিচয় থাকায় কেউ তাঁকে নাকি কাজ দেয় না। খ্যাতির বিড়ম্বনা নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন গুজরান করতে হচ্ছে তাঁকে। ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম ছিল তাঁর গ্রামের ছেলে। আমি সে-খবর জানতাম। তাঁকে বললাম, সাদ্দামকে বললে কিছু ত একটা করতে পারে। কোথাও বলে দিলো। আমার একথা শুনে দাদা এক অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে সেদিন ঐ প্রসঙ্গের ইতি টানলেন। পিসিআর রুম থেকে ক্যামেরাম্যান কাউন্ট ডাউন শুরু করলেন থ্রি, টু, ওয়ান…। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুরু হলো জাতীয় সংকট, নির্বাচন, রাজনীতির আলোচনা। শেখ হাসিনা কি পারবে পরিস্থিতি সামাল দিতে?
গত দেড় দশকে একাধিক টেলিভিশনে টক শো সঞ্চালনার সুবাদে দেশের খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী বিভিন্ন মানুষের সাথে আমার এক ধরণের পরিচয় হয়েছে। নিছক পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এঁদের অনেকের সঙ্গে এক ধরণের আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এঁদের অনেককে দেখেছি ক্যামেরা অন হলে এক কথা বলেন। ক্যামেরা অফ হলে আরেক কথা। কিন্তু বিভুদাকে দেখেছি ভিন্ন রকম। তিনি যা বিশ্বাস করতেন অন-ক্যামেরা বা অফ-ক্যামেরায় একই কথা বলতেন। দ্বিস্বর তাঁর শুনিনি।
৭২ বছর বয়সে বিভুদা বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী ছিলেন। ৬৬, ৬৯, ৭১, ৭৫, ৮২, ৯০, ২৪, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, মুজিব, জাসদ, বাসদ, বাকশাল, তাহের, জিয়া, ভাসানি, ফরহাদ, মনিসিং, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা, নানা ঘটনাপ্রবাহ তিনি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ফার্স্টলুক, ফার্স্টহ্যান্ড অভিজ্ঞতায় তিনি কেবল সাংবাদিকতা করেননি। সমানভাবে লিখে গেছেন পত্রিকার পাতায়। আমাদের শৈশবে যায় যায় দিন পর্বে তিনিই ছিলেন তারিখ ইব্রাহিম। পরে জেনেছি তিনি বিভুরঞ্জন সরকার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, চলতিপত্রে তাঁর কলাম ছিল আমাদের কাছে সকালের উপাদেয় নাস্তা। আমাদের মতো বাম রাজনীতি করা শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক খোরাক। বিভুদা নিজে ছিলেন বামপন্থার অনুসারী। কিন্তু বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতবাদ তাঁর সাংবাদিকতাকে আড়ষ্ট করতে পারেনি। তিনি ছিলেন সব সময় নির্মোহ সত্যান্বয়ী। কিন্তু সত্য যে কত বড় কঠিন আর নিষ্ঠুর। বিভুদা হয়তো নিজের জীবনের বিনিময়ে তা বুঝিয়ে গেলেন।
বিভুদা আমার কাছে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার জর্জরিত আহত রক্তাক্ত এক নিঃসঙ্গ নীলকণ্ঠ পাখি। জীবদ্দশায় যে পাখির কষ্টগুলোকে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি অথবা বুঝতে চাইনি। আমাদের অক্ষমতা আর গ্লানিগুলোকে ক্ষমা কোরো দাদা।
- (আশরাফুল আযম খান: সাংবাদিক।)(সৌজন্যে:সিলেট-টু-ডে-২৪)

