কালজয়ী সঙ্গীত বিশারদ ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান

প্রান্তডেস্ক:‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই…’ ‘গুন গুনা গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রোমরা যায়…,’ ‘চারা গাছে ফুল ফুইটাছে ডাল ভাইঙ্গো নারে মালী…,’বন্ধু রঙিলা, রঙিলা, রঙিলারে আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলারে…,’‘আগুন জ্বালাইস না আমার গায়রে…’, ‘বউ কথা কও বইলা পাখি ডাকে সকাল সাঁঝে…’, ‘ আগে জানিনারে দয়াল তোর পিরীতে পরান যাবে…’, ‘নিরিখ বান্ধরে দুই নয়নে ভুইলো না মন তারে…’, কোন বা রংঙে বাইনধাছো ঘর খানা মিছা দুনিয়ার মাঝে গো সাঁইজী…’
এক সময় দেশমাতানো, কালজয়ী এসব গানের সুরকার, গীতিকার, শিল্পী ছিলেন ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান। জাদুভরা কন্ঠে, সুরে আবহমান বাংলার লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে যে সব ক্ষণজন্মা পুরুষেরা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাঁদের অন্যতম, লোক সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান।
♦১৯২০ সালের ১ আগস্ট মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার ইরতা-কাশিমপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আফসার আলী খান, মা বেদৌরা খাতুন।
♦কিশোর বয়স থেকেই তিনি গান গাওয়া শুরু করেন। শুরুতেই তিনি ভারতের ‘পদ্ম ভূষণ’ উপাধী প্রাপ্ত ওস্তাদ নেসার হোসেনের সংস্পর্শে আসেন এবং দীর্ঘদিন তাঁর কাছ থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন। একাগ্র অনুশীলনের ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে গ্রাম বাংলার আবহমান কালের মাটির সুরে দোতরা সহযোগে লোক সঙ্গীতের চর্চা করতেন। চলমান জীবনের ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে কত বিচিত্র অবস্থায় যে তিনি লোক সঙ্গীত সংগ্রহ করেছেন এবং লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই।
♦সং পাবলিসিটি, আকাশবাণী, মেগাফোন কোং, হিজ মাষ্টার ভয়েজ (H.M.V.) কোং সবখানেই নিজের শিল্প প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি ১৯৪৩ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তান রেডিওতে উক্ত পদে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পি,আই,এ, আর্টস একাডেমিতে যোগদান করেন। বাংলাদেশের লোকগীতি পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে তিনি উর্দুভাষী শিল্পীদের দিয়ে প্রচুর বাংলা গান রেকর্ড করিয়েছেন। সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে ১৯৬২ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার গৌরব বয়ে আনেন । এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড, বার্মা, মালয়েশিয়া, চীন, রাশিয়া, প্রভৃতি দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন।
♦বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অল্প কিছু পূর্বে ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান করাচী থেকে ঢাকা চলে আসেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে সেই উদ্দীপনার মুহূর্তে তাঁর রচিত গান ‘বাংলা মায়ের রাখাল ছেলে বাঁশী দিল টান, শোন ভাই হিন্দু মুসলমান’ এবং ‘বাংলাদেশের মাটি ওগো তুমি আমার জন্ম স্মৃতি, আহা তোমার কোলে জন্য লইয়া ধন্য হইল মোর বসতি’ বহুল প্রচলিত হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি গ্রামে গঞ্জে যুদ্ধের গান গেয়ে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন লড়াকু বাঙালিদের।
♦শিল্পী নিজে প্রায় তিরিশ বছর গান গেয়েছেন, এছাড়াও তিনি কলকাতায় চিত্রায়িত “অভিযাত্রী” পাকিস্তান আমলের “আকাশ আর মাটি”, “জোয়ার ভাটা”, “সাত ভাই চম্পা”, “অরুন বরুন কিরণমালা” স্বাধীনতা উত্তরকালে “দয়াল মুর্শিদ”, “সুজন সখী”, “অনেক দিন আগে”, “এক মুঠো ভাত” ইত্যাদি ছায়া ছবিতে গায়ক, সুরকার, গীতিকার হিসেবেও তাঁর প্রতিভার অমর স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
♦৬০ এর দশকে অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীনের অনুরোধে তিনি প্রথমদিকে প্রচুর লালনগীতি, কালুশাহ ফকির, পাগলা কানাই, হাসন রাজা, বাবু হর্ষনাথের গানে সুরারোপ করেন- যা বিশেষজ্ঞদের অনুরোধে পরবর্তীকালে আর করেননি।
♦একজন শিল্পী, রচয়িতা, শিল্প সংগ্রহক সুরকার হিসেবে তাঁর সারা জীবনটাই কৃতিত্ব ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
♦সঙ্গীতে অবদানের জন্য ২১শে পদক প্রাপ্ত হন ১৯৮০ সালে। তারপর বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলা একডেমী পুরস্কার, কালুশাহ সঙ্গীত পুরস্কার, গীতিকবি সংসদ পুরস্কার, লেখক কল্যাণ সংস্থা কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা ও ট্রফি, পতাকা পদক, জাতীয় রবীন্দ্র পরিষদ সম্মাননা পদক লাভ করেন। মানিকগঞ্জ সহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ ঢাকা সংগীতে আবদানের জন্য ২০০১ সনে তাঁকে মরণোত্তর পুরষ্কার ও সংবর্ধনা প্রদান করে। এছাড়া লালন একাডেমী এবং নজরুল একাডেমীও তাঁকে মরণোত্তর পুরস্কার প্রদান করে।
♦ওস্তাদ মোমতাজ আলী খাঁন ৬৪ সালে টিভির জন্ম লগ্ন থেকে এবং রেডিওতে যোগ দিয়ে আমৃত্যু নিজেকে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে রেখেছিলেন এ দুটি মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন, কাজ করেছেন ঢাকা বিভাগের লোকসঙ্গীত পরীক্ষক হিসেবেও, ছায়ানটের লোক সঙ্গীতের প্রধান ছিলেন আমৃত্যু। উপমহাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ওস্তাদ মোমতাজ আলী খানের নিজের হাতে গড়া, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম, লায়লা আরজুমান্দ বানু, নীনা হামিদ, মাহবুবা রহমান, আবদুল লতিফ, ইসমত আরা, ফেরদৌসি রহমান, মোস্তফা জামান আব্বাসী উল্লেখযোগ্য।
সাময়িকভাবে যে সব শিল্পী তাঁর কাছে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং রেকর্ড বের করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, আব্দুর রউফ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, মীনা বড়ুয়া প্রমুখ। এছাড়া ♦উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী শচীন দেব বর্মন তাঁর সুরারোপিত ‘বন্ধু রঙিলা রঙিলারে আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলারে’, গানটি গেয়ে তৎকালীন সময় আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পূর্ণদাস বাউলের কণ্ঠে গীত ‘চুন বেশী খাইলে মুখ পুইড়া যায়’ প্রচুর সমাদৃত হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের গানও তিনি সুর করতেন, একমাত্র ওস্তাদ মোমতাজ আলী খাঁন ছাড়া তাঁর গানের সুর করার অনুমতি আর কাউকে তিনি দেননি। জসীমউদ্দীনের চার ভাগের তিন ভাগ গানের সুর করেছেন ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান। কবি জসীমউদ্দিনের খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। পল্লীকবি জসীমউদ্দিন যে ধারায় সাহিত্য ও সঙ্গীত রচনা করে অমর হয়ে আছেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আজীবন যে ভাব কল্পনায় আবিষ্ট হয়ে তুলির আঁচড়ে জীবনকে চিত্রে উদ্ভাসিত করে বিশ্ব খ্যাতি পেয়েছেন, সেই একই ভাব ধারায় ওস্তাদ মোমতাজ আলী খানও সঙ্গীত সাধনা করে গেছেন। উক্ত তিনজনের ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত মধুর। একে অপরের পরিপূরক যেন। এই মহান সুর সাধক কথা বলতেন কম, দেশকে নতুন কিছু দেবার জন্য সদাই যেন মগ্ন থাকতেন সুরের সাধনায়। তাঁর রচিত, সংগৃহীত এবং সুরারোপিত গানের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।
১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান ৭০ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
♦তথ্য সূত্রঃ
ক. রূপু খান।
খ. মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাস।
গ. মানিকগঞ্জ উৎসব স্মরণিকা ২০০২।
ঘ. মানিকগঞ্জের শত মানিক গ্রন্থ।
ঘ. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান।

