শতবর্ষ পরেও যার প্রয়োজন ফুরোয় না : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল:যার মৃত্যুতে কবিতা লিখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জীবনানন্দ দাশ-তিনি হলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন মেধাবী ব্যারিস্টার, দূরদর্শী রাজনীতিক, প্রজ্ঞাবান সাংবাদিক ও সংবেদনশীল কবি।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু ঘটে ১৯২৫ সালের ১৬ জুন, কলকাতায়। সে সময় তিনি ছিলেন কলকাতা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫ বছর। তার প্রয়াণ দিনেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ / মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
সেদিনই তাকে স্মরণ করে কবিতা লিখেন কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ। এ থেকেই বোঝা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে চিত্তরঞ্জন দাশের অবস্থান কতখানি শক্ত ও প্রভাবশালী ছিল।
রাজনীতিক হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি ‘দেশবন্ধু’। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। পরে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে কংগ্রেস ত্যাগ করে গঠন করেন ‘স্বরাজ পার্টি’। বাংলায় এই দলটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে তিনি নগর প্রশাসনের নেতৃত্বও দেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষে ও বাংলার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন আন্তরিকভাবে নিবেদিত।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একসময় তিনি নিজেই কলকাতার রাস্তায় পিকেটিং করতেন। আলীপুর বোমা মামলায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের পক্ষে তিনি ছিলেন প্রধান আইনজীবী। এ মামলায় তার যুক্তি ও বাগ্মীতাপূর্ণ সাফাই বক্তৃতা তাকে সর্বত্র জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেয়ায় তাকে কারাদ-ে দ-িত করা হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনে মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনি ফরওয়ার্ড ও লিবার্টি নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাগুলো স্বরাজ পার্টির মতাদর্শ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি, তরুণ সাংবাদিক ও লেখকদের অনুপ্রাণিত করে। দেশবন্ধুর এই সাংবাদিক প্রচেষ্টা কেবল তথ্য সরবরাহ করেনি, স্বদেশি চেতনাকেও বেগবান করেছে।
চিত্তরঞ্জন দাশ কবিতা রচনাও করেছেন। তার লেখা ‘ঈশ্বর’ ও ‘বারোবিলাসিনী’ কবিতাকে তৎকালীন সময়ে ‘অশ্লীল’ আখ্যায়িত করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তবে সাহিত্যরসিকদের একাংশ মনে করেন, এগুলোর ভাষা সাহসী হলেও চিন্তাধারায় নবতর। তার চারটি কাব্যগ্রন্থ হলোমালঞ্চ, সাগরসঙ্গীত, অন্তর্যামী ও ডালিম। কবিতা রচনার সময় তিনি নিয়মিত যেতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী পিতৃস্মৃতি-তে লিখেছেন“আমার যখন আট-নয় বছর বয়স, তখন চিত্তরঞ্জন দাশকে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই দেখতে পেতাম। তিনি সদ্য বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি শেষ করে কলকাতা হাইকোর্টে বসতে শুরু করেছেন।”
আজ তার কাব্যগ্রন্থগুলো হাতে পাওয়া কঠিন। অথচ এই বইগুলো শতবর্ষ আগের বাংলা ও ভারতের সমাজ-রাজনীতিকে বুঝতে হলে অপরিহার্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। তার জীবনীও এখন অনেকটাই অনুপলব্ধ, যা দুঃখজনক।
দেশবন্ধু কেবল রাজনীতিক ও কবি ছিলেন না, ছিলেন মানবিকতায় উজ্জ্বল এক চরিত্র। তিনি যেমন বিপ্লবীদের আর্থিক সহায়তা করেছেন, তেমনি গরিব কবি ও সাহিত্যিকদের প্রতিও ছিলেন সদয়। স্বভাবকবি গোবিন্দচন্দ্র দাসকে তিনি অর্থসহায়তা দেন। তার সখ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জন্ম ১৮৭০ সালের ৫ নভেম্বর, মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ী উপজেলার তেলিরবাগ গ্রামে। তার পিতা ভুবনমোহন দাশ ছিলেন একজন অ্যটর্নি।
দেশবন্ধুর মৃত্যু শতবর্ষে আমরা তার প্রতি জানাই গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধা।(সৌজন্যে:দৈনিক-সংবাদ)