গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ :দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ

প্রান্তডেস্ক:মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের চিরশত্রু ইরানের ওপর নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। শুক্রবার (১৩ জুন) রাজধানী তেহরানসহ দেশটির শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করা এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে অপারেশন রাইজিং লায়ন বা জেগে উঠা সিংহ। হামলার মূল কারণই ছিল পশ্চিমাদের ভাষায় ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচির সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া।
হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যকে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে ইরানও ইসরায়েলের হামলার জবাবে ‘ট্রু প্রমিস ৩’ নামের অভিযান শুরু করেছে।
শুক্রবার ভোররাত থেকে একের পর এক বিমান হামলায় প্রথমে ইরানের সামরিক নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা কাঠামোতে আঘাত করে। এরপর ধারাবাহিক হামলায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং শেষে দেশটির বৃহত্তম ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জে হামলা চালানো হয়।
ইরানের অভিজাত বাহিনী ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, জরুরি কমান্ড ইউনিটের প্রধান জেনারেল গোলাম আলি রশিদ ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন।
এছাড়া ইরানের পরমাণু জ্বালানি সংস্থার (এইওআই) সাবেক প্রধান ফিরেদুন আব্বাসি ও তেহরানের ইসলামি আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মোহাম্মদ মেহদি তেরাঞ্চিসহ হামলায় দেশটির ৬ জন পরমাণু বিজ্ঞানী প্রাণ হারিয়েছেন। এই ধরনের নেতৃত্বহীনতা ইরানকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে তুলবে বলে শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইরানের প্রধান সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জে কংক্রিট ও পাথরের সুরক্ষায় মাটির ৮ মিটার গভীরে অবস্থিত। হামলার পর সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে এলেও ভেতরের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করতে পারেনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। তবে ইসরায়েলের দাবি তারা এই ভূগর্ভস্থ স্থাপনার গুরুতর ক্ষতি করেছে।
ইসরায়েল এখনো ইরানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ফরদোতে হামলা চালায়নি। এটি প্রায় ৯০ মিটার মাটির নিচে অবস্থিত। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের জিবিউ-৫৭/বি ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা দিয়েই এটি ধ্বংস করা সম্ভব।
ইরান পাল্টা দেড় শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে। ড্রোনগুলো অত্যন্ত ধীরগতির। সবগুলো ড্রোনই মাঝপথে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েল-ইরানের মধ্যবর্তী প্রায় ৭০০ মাইল অতিক্রম করতে প্রায় সাত ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে ড্রোনগুলোর।
তাই ইসরায়েলে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে হলে আরও বড় পরিসরে ড্রোন হামলা চালানো প্রয়োজন হতো। এই মুহূর্তে ইসরায়েলের আকাশ নিয়ন্ত্রণে একচেটিয়া আধিপত্য দেখা যাচ্ছে।
বিকল্প প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ইরান সাইবার হামলা বা ভিন্ন কোনো হামলার পথ বেছে নিতে পারে, যদিও সেগুলো সফল হলেও রাজনৈতিকভাবে হয়তো সমপর্যায়ের জবাব হিসেবে বিবেচিত হবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো তেহরানের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে, কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসরায়েলের ওপর কোনো হামলা শুরু করবে না। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা হাজার মাইল দূরে থাকায় তাদের ভূমিকাও সীমিত।
নাতাঞ্জে সফল হামলা মানেই যুদ্ধের সমাপ্তি নয়। ফরদোর মতো ‘অপ্রবেশযোগ্য’ লক্ষ্য, ইরানের সম্ভাব্য পাল্টা হামলা এবং আন্তর্জাতিক চাপ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একটি দীর্ঘ, অনিশ্চিত ও বিস্তৃত যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যার কোনো তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি দেখা যাচ্ছে না।