বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে ফের ঘনীভূত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন একদিকে নাগরিক অসন্তোষ, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিভক্তির কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েছে।
গত বছর শিক্ষার্থীদের সহিংস আন্দোলনের পর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এরপর নতুন সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়নে ধীরগতি, ক্রমবর্ধমান গণবিক্ষোভ এবং জাতীয় ঐক্যের নানা আহ্বান সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিভাজন দিন দিন গভীর হচ্ছে।
ভোট নিয়ে মতবিরোধ
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এখনো নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করতে পারেনি। তিনি জানিয়েছেন, আগামী বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, নির্বাচন অবশ্যই ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে। দলটির মতে, সময়সীমা অনির্দিষ্ট থাকলে সরকারের প্রতি সমর্থন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও দ্রুত নির্বাচনের সময় নির্ধারণের আহ্বান জানিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে উঠে আসা ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি মনে করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত রাখা উচিত।
সংস্কার-প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ড. ইউনূস ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সাত সদস্যের ন্যাশনাল কনসেন্সাস কমিশন (এনসিসি) গঠিত হয়েছে, যার দায়িত্ব হলো ছয়টি আলাদা সংস্কার প্যানেলের সুপারিশের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করা।
কমিশনের তথ্যমতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো কিছু বিষয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সম্মতি মিলেছে। তবে সংবিধান সংশোধন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে এখনো মতপার্থক্য প্রবল।
আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহে সংস্কার সংক্রান্ত দ্বিতীয় দফার রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরে সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের লাগাতার বিক্ষোভে জনজীবন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে উৎকণ্ঠা। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষণা
চলতি মাসে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। এর ফলে দলটি ভবিষ্যতের যেকোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার হারিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় অংশগ্রহণমূলক নীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানান, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ফলে দেশে কার্যত ‘যুদ্ধাবস্থার মতো’ এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সম্মিলিত উদ্যোগ।’
এদিকে, ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় অভিযোগ করেন, বর্তমান সংকটের জন্য মূলত দায়ী ড. ইউনূসের ‘প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতি’।
বাংলাদেশ এখন এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে নির্বাচন, সংস্কার ও দলীয় বিভাজনের মতো বহুস্তরীয় সংকটের সমাধান ছাড়া স্থিতিশীলতা অর্জন অসম্ভব।