৬০০০ লাইসেন্সকৃত অস্ত্রের হদিস নেই
শুভ্র দেব:ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের তিন মেয়াদে সারা দেশে ১৯ হাজার ৫৯৪টি অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছিল। এরমধ্যে ১০ হাজারের মতো অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। গণ-অভ্যুত্থানের পর এসব লাইসেন্স ও লাইসেন্সের বিপরীতে ইস্যুকৃত অস্ত্র নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত বছর এসব লাইসেন্স বাতিল করে। তারপরই এসব লাইসেন্স ও অস্ত্র অবৈধ হয়ে যায়। লাইসেন্সের বিপরীতে যাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে তাদেরকে সেসব অস্ত্র থানায় জমা দেয়ার জন্য ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু লাইসেন্স স্থগিত করার পর থানায় জমা পড়েছে মাত্র ১৩ হাজার ৩৪৯টি অস্ত্র। এই হিসাবে ১৯ হাজার ৫৯৪টি লাইসেন্সের বিপরীতে ৬ হাজার ২৪৫টি অস্ত্র জমা দেয়া হয়নি। এসব অবৈধ অস্ত্র এখন কার কাছে আছে তারও কোনো হদিস নাই। ধারণা করা হচ্ছে এসব অস্ত্রের কিছুটা স্থগিত করা লাইসেন্সের মালিক ও কিছু অস্ত্র বিক্রি হয়ে যেতে পারে। এখন এসব অবৈধ অস্ত্র নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, সময় বেঁধে দেয়ার পরে অনেকে নিকটস্থ থানায় অস্ত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই ইচ্ছা করে, আবার কেউ আত্মগোপনে থাকায় অস্ত্র জমা দেননি। গণ-অভ্যুত্থানের পরে অনেক নেতাকর্মীর বাসায় হামলা হয়েছে। তখন অনেকের বাসায় থাকা অস্ত্র লুট হয়েছে। তাই এখন আর এসব অস্ত্রের হদিস মিলছে না। এসব অস্ত্র উদ্ধারের জন্য অনেক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু উদ্ধার করা যায়নি।
এদিকে, গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ করে ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুটে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই সময় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল লুট হয়। কিন্তু লুট হওয়া এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ গত ৯ মাসেও পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ ও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু অস্ত্র উদ্ধারে আশানুরূপ কোনো সাফল্য আসেনি। সন্ত্রাসী, চরমপন্থি থেকে শুরু করে জননিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি সংগঠনের কাছে চলে যাওয়া এসব মরণাস্ত্র উদ্ধার করতে না পারায় উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে। আদৌ এসব অস্ত্র পুরোপুরি উদ্ধার হবে কিনা এ নিয়েও কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না। একের পর এক হাত বদলের কারণে অস্ত্রগুলো এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ায় নাগালের বাইরে চলে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও গণভবন থেকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুট হয়। এ ছাড়া ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি গোলাবারুদ নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৮৪টি। এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৬৯টি। এ ছাড়া গোলাবারুদের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪৫টি। পুলিশ জানিয়েছে লুট হওয়া ১১০৬টি চায়না রাইফেলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৯৯১টি। আরেকটি মডেলের ১২টি রাইফেলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার হলেও ১টি উদ্ধার হয়নি। এসএমজি- (টি ৫৬) ২৫১টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২২১টি। এলএমজি (টি-৫৬) ৩৪টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩১টি। পিস্তল (টি-৫৪) ৫৩৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩২৫টি। ৯ ইনটু ১৯ মি.মি ১০৯২টি পিস্তলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৬৩০টি। ৯ ইনটু ১৯ এসএমজি/এসএমটি ৩৩টির মধ্যে সবক’টি উদ্ধার হয়েছে। ১২ বোরের শটগান ২০৭৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৬৭৫টি। ৩৮ মি.মি গ্যাস গান ৫৮৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৪৫৮টি। ৩৮ মি.মি টিয়ারগ্যাস লাঞ্চার ১৫টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৮টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ৭টি। ২৬ মি.মি পিস্তল ৩টির মধ্যে ১টি উদ্ধার হয়েছে। আর গোলাবারুদের মধ্যে বিভিন্ন বোরের ৬ লাখ ১২ হাজার ৯৮২টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৪টি। এখনো হয়নি ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪২৮টি। বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস সেলের ৩১ হাজার ২১২টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৯ হাজার ৮২১টি। বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস গ্রেনেডের ১৪৮৬টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১১৯৫টি। সাউন্ড গ্রেনেড ৪৭৪৬টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩৫৭৪টি। কালার স্মোক গ্রেনেড ২৭৩টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২৩২টি। সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৫৫টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩৩টি। ফ্ল্যাশ ব্যাং/৬ গ্রেনেড ৯০০টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৬১৬টি। হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে ১৭৮টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৬২টি। গণভবনের দায়িত্বে থাকা এসএসএফ সদস্যদের ৩২টি অত্যাধুনিক অস্ত্র এখনো পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্রের মধ্যে এসএমজি টি-৫৬, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন গান, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইসও ছিল। এখনো সেসব অস্ত্র উদ্ধারের তথ্য মেলেনি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাত বদল হয়ে লুট হওয়া এসব অস্ত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, দাগী সন্ত্রাসী, চরমপন্থি, স্থানীয় সন্ত্রাসী, জেল পলাতক আসামি, পেশাদার অপরাধী এমনকি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতে চলে গেছে। লুট হওয়ার পর বিভিন্ন সময় এসব অস্ত্র ব্যবহার করে খুনখারাবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে। তাই %