মাহবুবুর রহমান:আমার দিন কাটে ঘুমিয়ে, টি়ভি দেখে, কখনো পারিবারিক আড্ডায়। এন্ড্রয়েড ফোনটি সর্বক্ষণের সঙ্গী। এটাই আমার কাগজ-কলম, আমার টি়ভি-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ-লেখালেখি। একের ভেতর ত্রিশ বা চল্লিশ সুবিধা। মাথায় দু’বার অস্ত্রোপচার এবং সাড়ে চার মাস নার্সিং হোমে থাকার পর আমার নতুন জীবন। মাঝে-মাঝে স্মৃতির সাগরে ডুবে যাই। পঞ্চাশের শেষ এবং ষাট-সত্তরের কৈশোর তারুণ্যের দিনগুলো মনে পড়ে। ফিরে আসে আবারো সেই মোগলাবাজার।
রেবতী রমণ হাইস্কুলে আমার ক্লাসমেট মাহবুব চৌধুরী, থাকে নিউইয়র্কে। জ্যাকসন হাইটসের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। অসুস্থতার পর তার সাথে যোগাযোগ কমে যায়। এখন একেবারেই নেই। কেমন আছে জানার খুব ইচ্ছা। মাহবুবের বাড়ী তুড়ুকখলায়। দাউদপুর ইউনিয়নে। তুড়ুকখলার মকরম ভাই থাকেন মিশিগানে। তিনিই আমাকে খুঁজে বের করেছেন। আগে ফোনে আলাপ হতো। এখন আর হয় না। রেবতী রমণে তিনি ছিলেন আমাদের সিনিয়র। স্কুলের ক্যাপ্টেন। ফেঞ্চুগঞ্জের মানিকোনার আব্দুল হামিদ থাকেন ম্যানহাটানে। বাংলা পত্রিকায় প্রায়ই আসতেন। মানিকোনার আরো কয়েকজন রেবতী রমণের ছাত্র ছিলেন। তারা জায়গীর থাকতেন। এর মধ্যে আমার ক্লাসমেট মজনু (মজনুর রহমান) থাকতো মান্দাবাজে (মাহমুদাবাদে)। পরবর্তী জীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে পড়ে। দুঃখের বিষয়, অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
২০২০ সালের মার্চে ফোন পেয়ে ঢাকার গুলশানে আতিকের বাসায় আসে আশরাফ (মুকুল আশরাফ)। দীর্ঘ ৩২ বছর পর দেখা। হাইস্কুল জীবনে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। রাজনীতি, লেখালেখি শুরু এক সাথে। কত শত স্মৃতি। সে বার বাংলাদেশ সফরের প্রধান লক্ষ্য ছিল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ । মহামারী করোনা সব আটকে দেয়। আতিকের গুলশানের বাসায় ৫ মাস কাটানোর পর ফের নিউইয়র্ক। আশরাফের নিজস্ব বাসা মোহাম্মদপুরে। পরিবেশ বিষয়ক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। চেহারায় বয়সের ছাপ নেই। সে তুলনায় আমি বুড়িয়ে গেছি। সে কথা বলতেই স্বভাবসুলভ হাসিতে মুগ্ধতা ছড়ায়। আমাদের গল্প ফুরায় না। কথা ছিল তার বাসায় পরবর্তী আড্ডা হবে। করোনায় তা আর হয়নি।
মোগলাবাজারের সরিষপুর-বারীগ্রামের রেজওয়ান আহমদ ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। আশরাফের উদ্যোগে আমাদের যোগাযোগ ঘটে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। আমরা মোগলাবাজারে সংগঠনের শাখা খুলি। দু’বার সারদা হলে জেলা সম্মেলনে অংশ নিই। শহীদুল্লাহ কায়সার, মনোরমা মাসীমা প্রমুখ সম্মেলনকে আলোকিত করেন।
রেবতী রমণে আমাদের শিক্ষক ষোড়শী মোহন ভট্টাচার্য উঁচু স্তরের বামপন্থী কমরেড ছিলেন। এ তথ্য আমরা অনেক পরে জেনেছি। স্কুলে কখনো রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতেন না। তবে পাঠ্যসূচীর বাইরে নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। তিনি উদার মানবিক ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। আমরা আলোকিত হয়েছি তাঁর সান্নিধ্যে। মনে আছে, একবার কোন এক লেখকের বই নিষিদ্ধের দাবীতে অথবা প্রতিবাদে আমরা বিক্ষোভ করছিলাম। স্যার ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, বইটি পড়েছো? বললাম, না। স্যার বললেন, আগে পড়া উচিত ছিল। অন্যের কথায় নয়, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে।’ স্যারের জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবু আমার ক্লাসমেট। কনিষ্ঠ পুত্র মনি (সুকান্তি ভট্টাচার্য মনি) সিলেটে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত। ফেসবুকে আমার সাথে যোগাযোগ আছে। মনি’র শিশুকাল মনে করার চেষ্টা করি। তার অগ্রজ সন্টুর (স্নেহাংশু ভট্টাচার্য) কথা মনে আছে। যুগভেরীতে মাঝে-মধ্যে যেত। মনি’র মায়াবী ডাগর ডাগর চোখের কথা মনে পড়ে। সে চোখে তাকিয়ে থাকতো আমার পানে।
আমার চাচাতো ভাই মতিউর রহমান (আফতাব) একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে চাকুরীকালে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মোগলাবাজার রেল স্টেশনের একমাত্র চায়ের দোকানের মালিক ছিলেন তিনি। সে দোকানে আমার সময় কেটেছে নানাভাবে, সে গল্প অন্য একদিন করবো। হরিষপুর-বারীগ্রামের আমার ক্লাসমেট লিয়াকত আলী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। স্বাধীনতার পর সে বিডিআরে যোগদান করে।
আমি ও আশরাফ মাঝেমধ্যে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার শলা পরামর্শ করতাম। আমাদের যাওয়া হয়নি নানা কারণে।
আমার চাচাতে ভাই মুহিবুর রহমান (বাবু) একাত্তরের এপ্রিলে সিলেট-মোগলাবাজারের মধ্যবর্তী পারাইরচক লালমাটিয়ায় পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমানের গোলাবর্ষণে নিহত হন। একই সময় খালেরমুখ বাজারের গাজীপাড়ার এক বিলাত প্রবাসীও নিহত হন। তাঁরা বাসে করে সিলেট থেকে মোগলাবাজার ফিরছিলেন। পাকিস্তানি বিমান তাঁদের বাসকে তাড়া করে। বাসের সব যাত্রী নেমে পাশের পাকা ব্রীজের নীচে আশ্রয় নেন। বাবু ভাই ও বিলাত প্রবাসী, তাঁরা দু’জন আশ্রয় নেন বাসের নীচে। যুদ্ধ বিমান গোলাবর্ষণ করে বাসের উপর। ঘটনাস্থলেই তাঁদের মৃত্যু হয়।
একাত্তরের ডিসেম্বরে মোগলাবাজার রেল স্টেশন ও আশপাশে হাজারো ভারতীয় সৈনিকের অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। অনেক অফিসার আমাদের টঙ্গীঘরে বসে সময় কাটাতেন। বাড়ীর পুকুরটি বেশ বড়। অনেক মাছ। একদিন সৈনিকরা বোমা বা বিস্ফোরক ফেলে মাছ শিকার করে। বড়গুলো তারা নিয়ে যায়। ছোট মাছ ভেসে উঠে সারা পুকুর সাদা হয়ে যায়। এতো মাছ কে খাবে ? গ্রামবাসী কিছু নিলেও বাকীগুলো ফেলে দিতে হয়।
এখন যেখানে বজলুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সৈয়দা হাসিনা খাতুন গার্লস হাই্স্কুল, তার সামনের রেল স্টেশন সংলগ্ন খোলা মাঠে ভারতীয় মিলিটারী কমান্ডাররা হেলিকপ্টারে করে আসতেন, ক্যাম্প পরিদর্শনের পর ফিরে যেতেন। রেলের পুকুরের দক্ষিণের মাঠে যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সৈন্যদের শেষকৃত্য (দাহ) সম্পন্ন করা হতো। এ জন্য প্রচুর জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করা হতো আমাদের গ্রাম থেকে, গাছ কেটে।
১৯৭৩ সালের জুনে যুগভেরীতে যোগদানের আগ পর্যস্ত মোগলাবাজারের জীবনে জড়িয়ে ছিলাম ঘনিষ্ঠভাবে। আমাদের আড্ডায় নিয়মিত-অনিয়মিত অনেকেই আসতেন। নানা পেশা নানা মতের বন্ধুরা এক ছাতার নীচে। মত বিনিময়, গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা, খেলাধুলায় সময় কাটতো। কোন মারামারি হানাহানির কল্পনাও কেউ করতো না। সামাজিক অনেক কর্মকান্ডেও জড়িত ছিলাম। বেশীর ভাগ সময় মিলিত হতাম বাজারেই। আড্ডায় যারা থাকতেন তাদের মধ্যে ছিলেন আমার ফুফাত ভাই জাহানপুরের সিরাজুল ইসলাম (ইরশাদ),মাহমুদাবাদের মুকুল আশরাফ, আব্দুল মুকিত, হরগৌরির মুহিবুল হক (তুলা),আতাউর রহমান (টুনু), বাবুল মিয়া, রাঘবপুরের তোয়াহিদ, কান্দেবপুরের আব্দুল মান্নান, বাউরবাগের আব্দুল বাসিত, চুনু মিয়া, মির্জাপুরের নামর আলী, ছত্তিঘরের ফখরুল ইসলাম পংকী, সিরাজ, নেগালের মনির আহমদ, তুড়ুকখলার আব্দুল মতিন ও অন্যান্য।
আমি জানি না, এখন কে কেমন আছেন। জানার খুব ইচ্ছা হয়। পাঁচ/ছ’ দশক আগের স্মৃতি। মাথায় দু’বার অস্ত্রোপচারের পরও স্মৃতিটুকু যে বেঁচে আছে, সে জন্য আল্লাহর দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া।
আগামীতে আরো স্মৃতিচারণ থাকবে।