বিডিআর বিদ্রোহ মুখখুললেন মইন ইউ আহমেদ, দিলেন চাঞ্চল্যকর তথ্য
সাবেক জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। ছবি: বিবিসি থেকে
প্রান্তডেস্ক:বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ।
তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফট্যানেন্ট জেলারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা)। তিনি তার কাজ সঠিভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি। কারণ অনেকে জেলে ছিল, অনেককে প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি। আমার কাছে এসে বেশ কয়েকবার তার সমস্যার কথা তুলে ধরেন। আমি আশা করি, তিনি এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়েছেন। তিনি এই তদন্ত কমিটি পুনর্গঠিত করে জড়িতদের বের করতে সক্ষম হবেন। আমি সরকার গঠনের পর তাকে এই বিষয়ে অনুরোধ করেছি।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড, কেমন ছিল সেদিনটি
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, সেদিন (২০০৯ সালের) ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সাড়ে সাতটায় সেনাসদরের প্রতিদিনের মতো কাজ শুরু হয়। সকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল যেখানে সেনাবাহিনীর পরবর্তী বছরের কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকালে আমি সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতু নিচ্ছিলাম। এমন সময় সিজিএস লেফটনেন্ট জেলারেল সিনহা আমার কাছে এসে বলেন, আমাদের কাছে কিছু মর্টার আছে, যা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এর গুদামজাত এবং রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন। বিডিআর এগুলো ব্যবহার করে। এগুলো তারা নিয়ে গেলে আমাদের উপকার হবে।
তিনি আরও বলেন, এরপর আমি বিডিআর এর ডিজি জেনারেল শাকিলের সঙ্গে কথা বললে তিনি এগুলো নিতে রাজি হন। আমার বিশ্বাস তিনি তখন পর্যন্ত এই বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এরপর আমি আর সিজিএস মিটিংয়ের জন্য যাই। ৯টাই সেই মিটিং শুরু হয়। আমারা সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ি সেখানে। সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ রুমে প্রবেশ করেন। আমাকে বলেন, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পর আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তাকে ফোন ব্যস্ত পাই।
তিনি আরও বলেন, ৯টা ৪৭ মিনিটে ডিজি বিডিআরকে ফোনে পাওয়া যায়। তিনি আমাকে জানান, দরবার চলাকালীন দুইজন সশস্ত্র সৈনিক প্রবেশ করে একজন আমার পিছনে দাঁড়ায়। এরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে থাকা সৈনিকরা দরবার হল থেকে বের হয়ে যায়। এগুলো সবই মনে হয় প্ল্যান করা এবং প্ল্যান অনুযায়ী, সব চলছে।
তিনি আরও বলেন, আমি সেক্টর কমান্ডার এবং ব্যাটিলিয়ান কমান্ডারদেরকে পাঠিয়েছি তাদের ফেরত আনার জন্য। তখন আমি তাকে অপারেশনের কথা জানাই। ৯টা ৫৪ মিনিটে আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। এর মধ্যেই তিনি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গেছিলেন।
এ সময় আমি তাকে অপারেশনের কথা জানালে তিনি জানতে চান, কতক্ষণ সময় লাগবে এই ব্রিগেডকে তৈরি করতে? আমি সময় জানিয়ে ব্রিগেডকে পিলাখানায় যাওয়ার জন্য তার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় লাগলেও ৪৬ ব্রিগেড ১ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে। ব্রিগেড কমান্ডারের নেতৃত্বে ১০ জন অফিসার এবং ৬৫৫ জন অফিসার যাত্রা শুরু করেন।
তিনি বলেন, এদিকে বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর সামনে আক্রমণ প্রতিহত করতে রকেট লাঞ্ছার, মর্টারসহ অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করে। বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছালে বিদ্রোহীরা একটি পিকআপ লক্ষ করে রকেট হামলা চালায়। এতে চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান।
লেফটন্যনাট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী, সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই ডিজি, ডিডিজি, কর্নেল আনিস, কর্নেল কায়সারসহ অনেক অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমাদের টিম পৌছায় ১১টার পর।
সাবেক সেনাপ্রধান জানান, ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এসময় তিনি তার ঊর্ধতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশএর অনুমতি চাইলেও তিনি তা পাননি। অনুমতি পেলে হয়ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সুবিধা হত এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হত না। ১১ টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।
বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, কোন আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে তখন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। বেলা ১২টায় তিনি আমাকে ফোন করে জরুরিভিত্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করতে বলেন। বেলা ১টার দিকে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান।
তিনি আরও বলেন, আমি যমুনায় যাবারও ঘন্টাখানেক পর বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান সেখানে আসেন। অর্থ্যাৎ তাদেরকে আমার পরে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। অনেকক্ষণ পর তারা সেখানে আসলে আমাদের জানানো হয়, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম বিদ্রোহীদের একটি দল নিয়ে যমুনাতে আসছে এবং তারা সাধারণ ক্ষমা চায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে আমরা যেন তাদের বলি। তখন আমি তাকে বলি, অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের কোন দাবি মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন প্রথমত, অফিসার হত্যা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের সবাইকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণ করতে হবে এবং চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমা দেয়ার প্রশ্নই নেই।
১৪ জন বিদ্রোহী ৩টা ৪৮ মিনিটে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে যমুনাত আসেন। তাদের একটি বড় রুমে রাখা হয়। আমি তখন আমার এডিসি জুনায়েদকে বিদ্রোহী নেতাদের নিয়ে আসতে বলি। ডিএডি তৌহিদ যখন আসেন তখন আমি পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সকাল ৯ টায় বিদ্রোহীরা আমাকে একটি রুমে তালা মেরে রাখে। মাত্রই তালা খুলে আমাকে নিয়ে আসা হয়। আমি কিছুই জানি না।
মইন ইউ আহমেদ বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তখন আমি তাকে বলি, আপনি জানেন না, এখানে বাকি যারা আছেন তারা তো জানেন। তাদের গিয়ে জিজ্ঞেসা করেন এবং আমার জানান। তিনি এরপর ভিতরে চলে যান। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তাকে নিয়ে আসা হয়। তখন ডিএডি তৌহিদ বলেন, স্যার এরা সবই জানেন। কিন্তু কিছুই বলছেন না।
এর কিছুক্ষণ পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলোচনার জন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে বসেন। ছিলেন নানক, মির্জা আজম এবং তাপস। আলোচনায় কী হয়েছে তা আমার জানা নেই। কিছুক্ষণ পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকে বের হয়ে শুধু আমাকে ডাক দেন। আমি ভিতরে গিয়ে দেখি ওই ১৪ জন নিচে তাকিয়ে আছে। তাদের কাপড়ের অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হয় রাস্তার বখাটে ছেলে।
আলোচনায় কী হয়েছে জানি তা। তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বললেন, তোমরা অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দাও, ব্যারাকে ফিরে যাও। পরে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন।
আলোচনা শেষে নানক সাংবাদিকদের জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং বিদ্রোহীরা আত্মসমপর্ণ করেছেন।
বিদ্রোহীরা ৬টা ৩৭ মিনিটে যমুনা ত্যাগ করে পিলখানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পিলখানার পৌঁছে তারা ঘোষণা দেয়, যতক্ষণ সাধারণ ক্ষমার প্রজ্ঞাপন না দেয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আত্মসমপর্ণ করবে না। তারা আবারও গোলাগুলি করতে শুরু করে এবং অফিসারদের খুঁজতে থাকে।
রাত ১২ টয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আইন প্রতিমন্ত্রী তাপস এবং আইজিপি আলোচনার জন্য পিলখানায় যান। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা কিছু অস্ত্র সমপর্ণ করে এবং ৮টি পরিবারকে মুক্তি দেয় যার মধ্যে ৩টি পরিবার ছিল সেনাবাহিনীর অফিসারদের পরিবার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জানতেন, অফিসার্স এবং পরিবারদের কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাদের মুক্তির ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেননি এবং খোঁজখবরও নেননি।
২৬ ফেব্রয়ারি সকাল থেকেই বিদ্রোহীরা আবারও গোলাগুলি শুরু করে এবং অফিসারদের খুঁজতে থাকে। তারা কোয়ার্টার গার্ডে অফিসার এবং পরিবারদের হত্যার প্রস্তুতি নিতে থাকে। সকাল ১০টার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবার আমাকে যমুনায় যেতে বলেন।
ভিডিওতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন মইন ইউ আহমেদ। এ সময় বিডিয়ার বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা বই খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি।