শেখ হাসিনার পতনে আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষোভ ও বিস্ময়
দলটির ‘হতভম্ভ’ নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যেই তৈরি হয়েছে ক্ষোভ এবং বিস্ময়, কারণ এমন কিছু হতে পারে তার কোনো ধারণা একদিন আগেও তারা পাননি। গত দুই দিনে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী কয়েকজনের সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
যদিও শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জে ‘তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার’ প্রতিবাদে মঙ্গলবার দুই দফা মিছিল ও সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগের একদল নেতাকর্মী।
এর মাধ্যমে দেশের রাজনীতির মতো ‘আওয়ামী লীগেও আপাতত শেখ হাসিনা অধ্যায় শেষ হলো’ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। কিছুদিন আগেও যেমন আজকের পরিস্থিতি অবাস্তব ছিল। তবে এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ও তার ছেলের জয়ের কথা আমলে নিলে আপাতত তার রাজনীতিতে ফেরা কঠিন।’
উল্লেখ্য, সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা সামরিক হেলিকপ্টারে প্রথমে ত্রিপুরার আগরতলা ও পরে সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দিল্লি পৌঁছান।
এরপরই ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে আন্দোলনকারীরা এবং ওই দিন বিকেলেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বঙ্গবন্ধু ভবন ও জাদুঘর। হামলা হয় শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনেও।
সিনিয়র নেতারা কিছু জানতেন কী
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাতকারে সজিব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, ‘তার মা একদিন আগে অর্থাৎ রোববার থেকেই পদত্যাগের চিন্তা করছিলেন।’
যদিও দলের সিনিয়র নেতাদের সবাই এ বার্তা পাননি বা তাদেরকে এ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। কিংবা সিনিয়র নেতাদের একটি বড় অংশ বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরে পড়তে পেরেছেন।
রোববারই আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর দু’জন সদস্য আব্দুর রহমান ও ড. আব্দুর রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনকে তারা রাজপথেই মোকাবেলা করবেন।’ অর্থাৎ আন্দোলন দমন করে ক্ষমতায় থাকার বিষয়ে তখনো তারা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী।
ওই দিনও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সাথে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে এবং এসব সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকে ওই দুই নেতাই আত্মগোপনে রয়েছেন এবং পরে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাদের একজনের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন গতকাল মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে বলেন ‘ওনারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে এমন কিছু হয়ে যাবে।’
তবে ধারণা করা হয়, শেখ হাসিনার সরকার ও দলের কিছু লোকজন অবস্থা অনুধাবন করে শনি ও রোববার ঢাকা ছেড়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন।
আওয়ামী লীগের খুলনা অঞ্চলের একটি জেলার প্রবীণ একজন নেতা অবশ্য বলেন তিনি মনে করেন তার দল এমন অবস্থায় এবারেই প্রথম পড়েনি।
তিনি বলেছিলেন, ‘পঁচাত্তরের পনেরোই অগাস্টে আমি ডিগ্রির ছাত্র ও দলের কর্মী। হুট করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেলাম। তখন আমরা এমন পরিস্থিতিতেই পড়েছিলাম। বহু বছর পালিয়েছিলাম। ঘুরে দাঁড়াতে সময় লেগেছিল। এখন শেখ হাসিনার পর কে হাল ধরবেন আমি জানি না। তবে সময় হলে কেউ না কেউ আসবেই।’
উল্লেখ্য, পচাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৮১ সালের মে মাসে দেশে ফিরে এসে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। তার আগে অবশ্য ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলটির রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন শুরু হয়েছিল।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন এমন একজন বলছেন যে এবারের নতুন পরিস্থিতি মেনে নেয়া ও এতে ধাতস্থ হতে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনেক সময় লাগবে।
মঙ্গলবার বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘অনেকেই হয়তো রাজনীতিই ছেড়ে দিবেন। পরে কী হবে আমি জানি না।’
এবারের সহিংসতায় ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে পরে মারা গেছেন।
ওই এলাকাতেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এমন একজন বলেন, তিনি মনে করেন, ‘শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ায় আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর আপাতত কোনো সুযোগ নেই।’
‘দেশত্যাগ মেনে নেয়া কঠিন’
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেতা বলেন, তিনি মনে করেন, ‘ক্ষমতা হারানোর চেয়ে বড় আঘাত হলো দলীয় সভানেত্রীর দেশ ছাড়া।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এর থেকে মৃত্যু হয়তো শ্রেয় ছিল…!! বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে…আপনাকেও না হয় মেরে ফেলতো…আমি গৌরবের মৃত্যু নিয়েই যেতে চাই….আমি গৌরবের পরাজয় চাই….!!’
অর্থাৎ শেখ হাসিনার এভাবে চলে যাওয়াটাও দলের অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। তারা মনে করছেন, এটি তাদের জন্য অসম্মানজনক, যা রাজনৈতিকভাবেও তাদের জন্য বড় একটি আঘাত।
আবার কেউ কেউ ফেসবুক পোস্ট দিয়ে বলছেন যে ‘পরিস্থিতি যাই হোক না কেন দলের আদর্শ নিয়েই থাকবেন তারা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা হেমায়েত উদ্দিন অবশ্য লিখেছেন, ‘আমি মুজিব আদর্শের সৈনিক, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই আদর্শ বুকে ধারণ করেই চলবো…’।
সূত্র : বিবিসি(সৌজন্যে:দৈনিক নয়া দিগন্ত)