‘ছাগলকাণ্ডের’ মতিউরের দেশ ছাড়ার গুঞ্জন
প্রান্তডেস্ক:জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোববার (২৩ জুন) বিকালে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়েছেন মতিউর রহমান। তার ঘনিষ্ঠ একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য জানিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে দেশের একটি জাতীয় গণমাধ্যম।
গণমাধ্যমটি জানায়, ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর থেকে মতিউর রহমানের হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। তার বিভিন্ন বাসভবনে খোঁজ নিয়েও সন্ধান মেলেনি। এমনকি কোরবানির ঈদের ছুটির পর অফিস খুললেও তিনি আর অফিসে আসেননি।
গণমাধ্যমটি ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর মতিউর রহমান ভারত থেকে সরাসরি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন। প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট তাকে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছে
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ছাগলকাণ্ডের পর ছেলেকে অস্বীকার করে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গাঢাকা দিয়েছিলেন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি। ফোনে যোগাযোগও ছিল সীমিত। সেই সময়ে অস্বীকার করা ছেলেকে নিরাপদে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে পড়াশোনা করা মতিউর রহমান অনেক কম্পানির ছায়া পরিচালক। একাধিক ছোট কম্পানি শেয়ারবাজারে আনার মাধ্যমে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। শেয়ারবাজার কারসাজিতে জড়িতদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের টিম গঠন
মতিউরের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিমও গঠন করা হয়েছে। দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ গত ৪ জুন কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
এর আগেও গত দুই যুগে চারবার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ পৃথকভাবে অনুসন্ধান করেছে দুদক। প্রতিবারই তিনি দুদক থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের কোনো তথ্য-প্রমাণ পায়নি দুদক। এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব বলেন, চারটি পুরনো অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছিল। তবে এখন নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা পুরনো কী কী অভিযোগে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন—সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখবেন।
এনবিআরের পদ হারালেন
ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে তাকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।
জানা গেছে, মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জায়গায় পদায়ন হয়েছে তাঁর। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার হিসেবে। সেই সময় বিভিন্ন কম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য এনবিআর ও দুদককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে রহস্যজনক কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থা দুটি।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে ছিলেন মতিউর রহমান। তবে ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘পরিচালক সরকারি পোস্ট। অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি ইস্যু না করলে চূড়ান্ত অপসারণ হবে না। তবে মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে, তাকে সরানো হবে। আমাদের সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অপসারণ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি ইস্যুর পর। তবে এখন থেকে মতিউর রহমান সোনালী ব্যাংকের কোনো সভায় থাকতে পারবেন না।’
এবার কোরবানির ঈদে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে মতিউর রহমানের ছেলে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন খামার থেকে ৭০ লাখ টাকার গরু কিনেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে উঠে আসে। এরপর থেকে মতিউর রহমানের ছেলের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপন; মতিউর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এই কর্মকর্তা দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এরইমধ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য জানতে মাঠে নেমেছে। প্রাথমিকভাবে কিছু সম্পদের তথ্যও পাওয়া গেছে। পূবাইলের খিলগাঁও মৌজায় ৫৫ বিঘা জমিতে মতিউর রহমানের রয়েছে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট। এই রিসোর্টে ১০০ টাকার টিকিট কেটে যে কেউ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরতে পারেন। নাটক, সিনেমার শুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেওয়ার বাইরেও এখানে আছে অবকাশ যাপনের সুযোগ। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে শতবিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে লাকি পার্ক নামে আলিশান রিসোর্ট, যার বর্তমান নাম ওয়ান্ডার পার্ক। এই পার্ক তৈরি করতে গিয়ে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।এর আগে, দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের খবর প্রকাশের পর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ অনেকেই ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন।(সৌজন্যে :দৈনিক ইত্তেফাক)