সিলেটের কৃতিসন্তান সুন্দরীমোহন দাশের কর্মকান্ড জনসমাজে তুলে ধরা বৃহত্তর সিলেটবাসীর নৈতিক দায়িত্ব
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ ২:৫৭ অপরাহ্ণ | সংবাদটি ২৮ বার পঠিত
সুধীনচট্টোপাধ্যায়::ভারতের একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে কলকাতার ন্যশনাল মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ, ১৯২১ সালের ১৪ এপ্রিল বলে ঘোষিত হয়েছে। এই দিনই অসহযোগ আন্দোলনের তহবিল থেকে ১৫ হাজার টাকা অনুদান নিয়ে ১১ নম্বর ওয়েলিংটন স্ট্রিটের ‘ফোর্ব’স ম্যানসন’-এ স্থাপিত হয়েছিল ন্যশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট। পরে ১৯৪৮-এ বউবাজারে ক্যালকাটা মেডিকেল স্কুলের সঙ্গে তা মিলে গিয়ে নাম হয় ন্যশনাল মেডিকেল কলেজ। ১৯৭৬ সালের ১১ জুন থেকে সেটি সরকারি মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত হয়। সংবাদে উল্লেখই নেই যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান, জাতীয় আন্দোলনের ফসল, দেশবাসীর আবেগ ও ভালোবাসার এই তীর্থপীঠে প্রথম থেকেই অধ্যক্ষের দায়ভার নিয়েছিলেন ত্যাগ ব্রতী, দেশসেবক, সিলেটের কৃতিসন্তান ড. সুন্দরীমোহন দাস। তিনিই তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন এই বিদ্যা কেন্দ্রকে।
সুন্দরীমোহন একালের বাঙালির কাছে প্রায় অশ্রুত একটি নাম। তাঁর পরিচয়ও প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে কালের ধুলোয়। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণের এক পাশে চরম উদাসীনতায় প্রায় পরিতক্ত্যের মতো বছরের দুটি দিন, জন্ম ও মৃত্যুদিনে মাল্যভূষিত তাঁর মর্মর মূর্তিটি অকৃতজ্ঞ বঙ্গবাসীর দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই কলেজেরই তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। দেশের মুক্তির সংগ্ৰামে, চিকিৎসা বিজ্ঞান পঠনপাঠনের ব্রতে, সামাজিক সংস্কারে কৃতসংকল্প, প্রগতিপন্থী, অগ্ৰণী এই হৃদয়বান মানুষটি ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছেন। অথচ এই মানুষটি তাঁর ডাক্তারী পেশার সমস্ত দায়দায়িত্ব সামলে, সাহিত্য চর্চা করেছেন, জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, নারীমুক্তি ও বিধবাবিবাহে উৎসাহী হয়ে অংশ নিয়েছেন।
দুই
ব্রিটিশ ভারতের শ্রীহট্ট জেলার দিঘলি গ্রামে ১৮৫৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর তাঁর জন্ম।ভা্রতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ(সিপাহি বিদ্রোহের) ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছে তখন। ভয়ে গ্ৰাম ছাড়ছে মানুষ। সুন্দরীমোহনের গর্ভবতী মা’ও নৌকায় ভেসেছিলেন। আর সেই জলের বুকে ভাসমান তরণীতে সময়ের অনেক আগে অপরিণত সুন্দরীমোহনের জন্ম হয়েছিল, শিশুটিকে তুলোর ঝুড়িতে রেখে তিলে তিলে বড়ো করা হয়। সাড়া জাগানো ঘটনা। পড়শীরা বললেন এ ছেলে ভবিষ্যতের বুকে আঁচড় কেটে যাবে। সুন্দরীমোহনের বাবা, স্বরূপচন্দ্র দাস ঢাকা কমিশনারেটের অধীন তৎকালীন শ্রীহট্ট কালেক্টরেটে দেওয়ানের কাজ করতেন। তাঁর পরিচিতি হয়, দেওয়ান স্বরূপ চাঁদ নামে। পরে পদোন্নতি হওয়ায় তিনি কালীঘাটের প্রধান দেওয়ান হয়ে কলকাতায় চলে যান। তখন সেখানে চলছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন।
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সুন্দরীমোহন প্রবেশিকা পরীক্ষা পর্যন্ত সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলে পড়াশোনা করার পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি হয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং এম বি পরীক্ষা খুব কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।তাঁর পড়াশোনায় পিতা স্বরূপচন্দ্রের পকেট থেকে একটি কানা কড়িও খরচ হয়নি, ছাত্রবৃত্তির টাকায় তিনি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন। কলকাতায় পড়াশোনার সময়েই তাঁর মনে স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। তিনি হিন্দু মেলার সংস্পর্শে আসেন, লাঠি খেলা, কুস্তি, নানা রকম শারীরিক কসরতে তিনি বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয়ত তাঁর সিলেটি বন্ধু বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল এবং আনন্দচন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় শিবনাথ শাস্ত্রীর নিকট সান্নিধ্যে আসেন, জাতপাতে ছিন্নভিন্ন হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ‘ব্রাহ্ম’ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ ইত্যাদি কাজেও আত্মনিয়োগ করে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দেন। পরবর্তী কালে নিজেও বিধবা রমণী হেমাঙ্গিনী দেবীকে বিয়ে করেন। দেশব্রত, বিদেশের পণ্য বর্জন, সমাজ, শিক্ষা ও নারী অগ্রগতির কাজে দায়িত্ব গ্রহণ সহ, কৃচ্ছসাধনের মধ্যে সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনের শপথ নিয়ে সুন্দরীমোহন কলকাতায় তাঁর শিক্ষার্থী জীবন শেষ করে দেশঘর সিলেটের দিঘলি গ্ৰামের উদ্দেশ্যে পা বাড়ান।
তিন
সিলেটের জল, মাটি, হাওয়া সুন্দরীমোহনের অন্তরের অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল। তাই পাশ করার পরই সিলেট জেলা বোর্ডে ডাক্তারের চাকরি নিয়ে তিনি হবিগঞ্জে চলে আসেন। তাঁর মনে হয়েছিল এখানকার মানুষের তাঁকে দরকার আছে। সারা দেশেই পাশ করা, প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল নগণ্য, হবিগঞ্জের তো কথাই নেই। মনপ্রাণ দিয়ে চিকিৎসা ও সেবাব্রতে তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দেন। তার সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজ গড়ে তোলা এবং বিধবা বিবাহে উৎসাহ দেওয়ার অপরাধে তিনি পৈতৃক ভিটেচ্যুত হন। তথাপি বিশ্বাস এবং অবস্থান থেকে তিনি এক চুলও নড়েননি। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়েছেন, মেয়েদের স্কুল তৈরির চেষ্টা করেছেন এবং প্রসূতি পরিষেবাগুলির উন্নতিতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তিনি সবিস্তারে লিখেছেন : “বৃদ্ধা ধাত্রীর রোজনামচা” বইটিতে।
১৮৯০ সালে প্লেগের ভয়াবহ সংক্রমণের মধ্যে সুন্দরীমোহন কলকাতা কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের চাকরি নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন। কিন্তু টিঁকতে পারলেন না। রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে ব্রিটিশ মালিকানাধীন কিছু সংস্থার চিনি এবং লবণের পুরনো মজুত বাজেয়াপ্ত করার কারণে কর্পোরেশন চেয়ারম্যানের সঙ্গে তীব্র মতভেদে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। লিখলেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংলাপ ভিত্তিক গ্ৰন্থ ‘পৌর দর্পণ’। অবশ্য ফিরেছিলেন আবার কর্পোরেশনে, যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মেয়র,….হাত লাগিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কাজে, ধাত্রী প্রশিক্ষণে এবং সবচেয়ে বড়ো কাজ, হাসপাতাল গড়ে তোলা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের পঠনপাঠনের সম্প্রসারণ। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও জাতীয় শিক্ষার আবহ তৈরি হয় তার পরিপূর্ণতা বিধানে তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন। চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউটের গোড়াপত্তন থেকেই তিনি ছিলেন ‘সেবক, সংগঠক ও অধ্যক্ষ’। আজ ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ বাংলার অন্যতম বৃহৎ ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শুরুর দিনগুলিতে কঠিন শ্রম, সংগ্ৰাম, তীব্র অর্থ সংকট ও কৃচ্ছ্রসাধন এবং দেশব্রতে দায়বদ্ধ থেকে যিনি এই বিদ্যা প্রতিষ্ঠানকে তিল তিল করে তৈরি করেছিলেন, সেই সুন্দরীমোহন আজ বিস্মৃত, নিষ্প্রাণ মর্মর মূর্তিতে নির্বাক দর্শক মাত্র।
চার
আগেই বলেছি, কলকাতায় পড়তে এসে তরুণ সুন্দরীমোহন সমাজ শোধন ও জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হন। কলকাতায় তাঁর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। উল্লাসকর দত্ত সহ একাধিক বিপ্লবী এখানে দিনের পর দিন আত্মগোপন করে থেকেছেন। বোমা তৈরিতে পারদর্শী সিলেটের আর এক সন্তান রাধাকিশোর শর্মাও অনেকদিন সুন্দরীমোহনের বাড়িতেই ছিলেন। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে আর্থিক সহায়তা সহ লেখালিখিও করেছেন সুন্দরীমোহন। স্বরাজের পথ, মুক্তির পথ খুঁজতে বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, লিয়াকত হোসেন প্রমুখতাঁর বাড়িতে বারংবার বৈঠকে বসেছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ দল তৈরির আগে স্বরাজ সমিতি গঠন করেছিলেন সুন্দরীমোহনের এই বাড়িতেই। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনেরও তিনি ছিলেন জোরালো সমর্থক।
ব্রিটিশ বিদ্যা ব্যবস্থার বদলে জাতীয় শিক্ষার প্রচলনের জন্যও সুন্দরীমোহন সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তিনি জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রধান সংগঠক এবং বেঙ্গল টেকনিকাল ইনস্টিটিউটের, বর্তমানের যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বলে খ্যাত, তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। রাধাগোবিন্দ করের নিজের হাতে তৈরি মেডিকেল স্কুল ও পরে কলেজে তিনি বিনা বেতনে পড়িয়েছেন।
স্বদেশের শিল্প গড়ে তোলাটা তাঁর কাছে নিছক কল্পনাছিল না, তিনি নিজের সঞ্চিত অর্থে হোসিয়ারি কারখানা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়ে যন্ত্রপাতি পর্যন্ত কিনে ফেলেন। ব্যবসা দাঁড়ায়নি, কিন্তু তার জন্যে মনে কোনো পরিতাপকে প্রশ্রয় দেননি। দেশজ ভেষজ ব্যবহার করে স্বদেশী ওষুধ শিল্প গড়ে তুলতেও তিনি ছিলেন সমান আগ্ৰহী। নিজের ছেলেকে সেজন্যে ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়তে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন।১৯৫০ সালের ৪ঠা এপ্রিল নিজের হাতে তৈরি ন্যাশনালডিক্যাল ইনস্টিটিউটে সুন্দরীমোহনের জীবনাবসান হয়। । তিনি তার দেহটি চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহারের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অনুরক্ত ছাত্র, শিক্ষকবৃন্দ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁর শেষ ইচ্ছা রাখতে পারেনি।
দেশের সেবায় ৯৩ বছরের দীর্ঘ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়োজিত, এই কর্মমুখর, মানব প্রেমিক, শ্রদ্ধেয় মানুষটির কথা বলতে পারাটাও পুণ্য অর্জনের সমান।উল্লেখ্য যে সুন্দরীমোহনদাশের মেয়ে কল্যনীদাশও তাঁর(কল্যনীদাশ’র) স্বামী বিরেশ মিশ্র ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের নিপীড়ীত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন সাম্যবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা ভারতের কমিউষ্টপার্টি (মার্কসবাদী)’র সদস্য হিসাবেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
★★