আজ মুক্ত চিন্তার অন্যতম পথিকৃৎ, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়’র মৃত্যুদিন
প্রান্তডেস্ক:অভিজিৎ রায় (১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ – ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রকৌশলী, ব্লগার ও লেখক।তিনি বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং সরকারের সেন্সরশিপ ও ব্লগারদের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমন্বয়কারী ছিলেন। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী হলেও, তার স্ব-প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইট “মুক্তমনা”-য় লেখালেখির জন্য অধিক পরিচিত লাভ করেন। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বের হওয়ার সময় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে আহত করে। বাংলাদেশী জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল।[
প্রাথমিক জীবন
অভিজিৎ রায় ১৯৭১ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর ভারতের আসাম রাজ্যের শিবনগরের নাজিরা ম্যাটার্নিটি সেন্টারে জন্মগ্রহণ করেন। সেসময় তার পিতা অজয় রায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় ছিলেন।
অভিজিৎ রায় ঢাকার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ সম্পন্ন করেন। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টায় যান এবং বাংলাদেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত সেখানে একজন প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করতেন। অভিজিৎ রায়ের পিতা ড. অজয় রায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একুশে পদকবিজয়ী একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
ব্যক্তিগত জীবন
২০০৭ সালে অভিজিৎ রায় রাফিদা আহমেদ বন্যা নামের একজন মুক্তমনা লেখিকাকে বিবাহ করেন। বন্যা পূর্ববিবাহিতা ছিলেন; প্রাক্তন স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পরে অভিজিতের সাথে তার বিয়ে হয়। অভিজিতের ক্ষেত্রে এটাই তার প্রথম বিয়ে ছিল। বন্যার প্রথম দাম্পত্য-জীবনে “তৃষা” নামে একজন কন্যাসন্তান ছিল।
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান এবং ফ্লোরিডায় তাদের বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান।
কর্মজীবন
অভিজিৎ রায় পেশায় একজন প্রকৌশলী ছিলেন। তবে তিনি নিয়মিত ব্লগ ও বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখালেখি করতেন। তিনি মোট ১০টি বই প্রকাশ করেন। বিজ্ঞান, নাস্তিকতাবাদ, বাস্তববাদ, সন্দেহবাদ ও যৌক্তিকতার ওপর ভিত্তি করে রচিত অবিশ্বাসের দর্শন এবং বিশ্বাসের ভাইরাস নামক তার দুটি বাংলা বই পাঠকমহলে বহুমুখী সমালোচনা লাভ করে।
মুক্তমনা ব্লগ
তিনি ২০০১ সালের দিকে সমমনা কয়েকজন লেখকদের নিয়ে মুক্তমনা নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। তিনি এই ওয়েবসাইটের আটজন নিয়ন্ত্রকদের অন্যতম ছিলেন। এই ওয়েবসাইটটি দ্য ববস সেরা অনলাইন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার, মানবাধিকার ও সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার প্রেক্ষিতে “মুক্তমনা” ওয়েবসাইট ২০০৭ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক অর্জন করে।
অভিজিৎ রায় তার ব্যক্তিগত আদর্শভিত্তিক রচনাগুলোর জন্য ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের নিকট থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে অনলাইনে বই কেনাকাটার ওয়েবসাইট, রকমারি.কমের মালিক ইসলামি মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি পাওয়ার পর তার ওয়েবসাইটে অভিজিতের বই বিক্রি করা বন্ধ করে দেন।
প্রতিবাদ
বহু বাংলাদেশী নাস্তিক ব্লগার ২০১৩ শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন করেন। একই বছর ইসলামের অবমাননার কারণে ইসলামি দলগুলো নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে শাপলা চত্বরে আন্দোলনের ডাক দেয়। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারি আহমেদ রাজীব হায়দার কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী কর্তৃক খুন হন। দ্য ববস সেরা অনলাইন পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন আনোয়ার আল-আওলাকি দ্বারা প্রভাবিত চার যুবক দ্বারা আক্রান্ত হন। শফিউল ইসলাম নামক একজন সমাজবিদ্যার অধ্যাপক ইসলামি মৌলদের হাতে নিহত হন।মহিউদ্দিনের ব্লগ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ইসলাম ও মুহাম্মাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে। বাংলাদেশ সরকার বহু ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে এবং এক ডজনের মতো ওয়েবসাইট ও ব্লগ বন্ধ করে দেয়। হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্স,কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে ব্লগারদের গ্রেপ্তারের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়।
অভিজিৎ রায় পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ছাড়াও সেন্টার ফর ইনক্যুয়ারি এবং ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিক্যাল ইউনিয়ন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার নিকট সমর্থনের আবেদন জানান। তিনি ঢাকা, নিউ ইয়র্ক সিটি, ওয়াশিংটন ডিসি, লন্ডন, অটোয়া প্রভৃতি শহরে বন্দী ব্লগারদের সমর্থনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। সালমান রুশদি, তসলিমা নাসরিন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হেমন্ত মেহতা, মারিয়াম নামাজি, অনু মুহাম্মদ, কাইয়ুম চোধুরী, অজয় রায়, রামেন্দু মজুমদার প্রভৃতি প্রথীতযশা ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবিরা বন্দী ব্লগারদের সমর্থনে সর্বসমক্ষে মতপ্রকাশ করে অভিজিতের সঙ্গে যোগ দেন।
হত্যা
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে অভিজিৎ একুশে বইমেলা চলাকালীন ঢাকা যাত্রা করেন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলায় তিনি ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা একটি রিকশায় করে একুশে বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার সময় সাড়ে আটটা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নিকটে অপরিচিত দুস্কৃতিকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। সাক্ষীদের মতে, দুইজন দুষ্কৃতিকারী তাদের থামিয়ে রিকশা থেকে নামিয়ে রাস্তায় ফেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের কোপাতে থাকেন। অভিজিতের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। তার স্ত্রীর কাঁধে ধারালো অস্ত্রের আঘাত লাগে এবং বাম হাতের আঙুলগুলি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। উভয়কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যাওয়া হলে অভিজিৎ রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মৃত্যুবরণ করেন। রাফিদা আহমেদ বন্যা চিকিৎসার পর বেঁচে যান।
অভিজিতের মৃত্যুর একদিন পরে আনসার বাংলা-৭ নামক একটি সংঘঠনএবং উপমহাদেশীয় আল কায়েদা শাখা এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। অভিজিতের পিতা অজয় রায় ২৭শে ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় হত্যার অভিযোগ দায়ের করেন।
১লা মার্চ অভিজিতের মৃতদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের নিকট রাখা হয়, যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। অভিজিতের ইচ্ছানুসারে তার মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণার জন্য প্রদান করা হয়।
২রা মার্চ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান ফারাবি শফিউর রহমান নামক একজনকে সন্দেহমূলকভাবে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের সন্দেহানুসারে, ফারাবি বিভিন্ন ব্যক্তিকে অভিজিতের অবস্থান, পরিচয় ও পরিবারের ছবি সম্বন্ধে তথ্য দিয়েছিলেন। ফারাবি অভিজিতকে বিভিন্ন সময় ব্লগ এবং ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইটে ঢাকা পৌঁছলে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের নিকট হতে সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ই মার্চ ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের চার সদস্যের দল বাংলাদেশের গোয়েন্দা দলের সাথে মিলিত ভাবে হত্যার স্থানটি পর্যবেক্ষণ করে প্রমাণ সংগ্রহ করেন।
বিচার
অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
লেখালেখি
অভিজিৎ রায় ইন্টারনেট, ম্যাগাজিন এবং দৈনিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তার লেখার বিষয় ছিলো আধুনিক বিজ্ঞান, নাস্তিকতা, সমকামিতা এবং দর্শন। মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশিত তার ১০টি বইগুলো হলো –
- আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫)
- মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭)
- স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮)
- সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০)
- অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১)
- বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২)
- ভালবাসা কারে কয় (২০১২)
- শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪)
- বিশ্বাসের ভাইরাস (২০১৪)
- ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫)