আজ ইংরেজ জীববিজ্ঞানী; বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন’র জন্ম দিন
প্রান্তডেস্ক:চার্লস ডারউইন (ইংরেজি: Charles Darwin; ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৯ – ১৯ এপ্রিল ১৮৮২) ঊনিশ শতকের একজন ইংরেজ জীববিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিবর্তনবাদের ধারণা দেন। তিনিই সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন যে সকল প্রকার প্রজাতিই কিছু সাধারণ পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত হয়েছে এবং তার এ পর্যবেক্ষণটি সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। বিবর্তনের এই নানান শাখা-প্রশাখায় ভাগ হবার বিন্যাসকে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন হিসাবে অভিহিত করেন। তার জীবদ্দশাতেই বিবর্তনবাদ একটি তত্ত্ব হিসাবে বিজ্ঞানী সমাজ ও অধিকাংশ সাধারণ মানুষের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে, তবে ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ এর মধ্যে বিকশিত আধুনিক বিবর্তনিক সংশ্লেষের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের গুরুত্ব পূর্ণরূপে অনুধাবন করা সম্ভব হয়। পরিবর্তিত রূপে ডারউইনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ছিল জীববিজ্ঞানের একত্রীকরণ তত্ত্ব, যা জীববৈচিত্রের ব্যাখ্যা প্রদান করে।
প্রকৃতির প্রতি ডারউইনের গভীর আগ্রহের কারণে তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়নে মনোযোগী ছিলেন না; বরং তিনি সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। অতঃপর ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন তার মধ্যকার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আগ্রহকে অনুপ্রাণিত করে। এইচ এম এস বিগলে তার পাঁচ বছরব্যাপী যাত্রা তাকে একজন ভূতাত্ত্বিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিগলের ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হলে তা তাকে জনপ্রিয় লেখকের খ্যাতি এনে দেয়।
ভ্রমণকালে তার সংগৃহীত বন্যপ্রাণ ও ফসিলের ভৌগোলিক বণ্টন দেখে কৌতূহলী হয়ে ডারউইন প্রজাতির ট্রান্সমিউটেশান নিয়ে অনুসন্ধান করেন এবং ১৮৩৮ সালে তার প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদটি দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। যদিও তিনি তার এ ধারণাটি নিয়ে কিছু প্রকৃতিবিদের সাথে আলোচনা করেছিলেন, তার বিস্তারিত গবেষণা কাজের জন্যে আরও সময়ের প্রয়োজন ছিল এবং তাকে তার প্রধান ক্ষেত্র ভূতত্ত্ব নিয়েও কাজ করতে হচ্ছিল। তিনি তার তত্ত্বটি লিখছিলেন যখন ১৮৫৮ সালে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস তাকে একই ধরনের চিন্তাভাবনা সংবলিত একটি প্রবন্ধ পাঠান, যার ফলে অনতিবিলম্বে তাদের উভয়ের তত্ত্ব যৌথভাবে প্রকাশিত হয়।ডারউইনের তত্ত্ব কিছু পরিবর্তিত হয়ে প্রকৃতিতে বহুল বৈচিত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। ১৮৭১ সালে তিনি মানব বিবর্তন এবং যৌন নির্বাচন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন এবং মানুষের ক্রমনোন্নয়ন, ও তারপর পরই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীতে অনুভূতির প্রকাশ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। বৃক্ষ নিয়ে তার গবেষণা কয়েকটি গ্রন্থে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং তার শেষ বইতে তিনি কেঁচো এবং মাটির উপর এদের প্রভাব নিয়ে তার গবেষণা প্রকাশ করেন।
ডারউইনের বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতির কারণে তিনি ছিলেন ১৯ শতকের মাত্র পাঁচজন রাজপরিবারবহির্ভূত ব্যক্তিদের একজন যারা রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্মান লাভ করেন। ডারউইনকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে সমাহিত করা হয়, বিজ্ঞানী জন হার্শেল ও আইজ্যাক নিউটনের সমাধির পাশে।
জীবনী
প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা
চার্লস রবার্ট ডারউইন তাঁর পরিবারিক বাড়ি, দ্য মাউন্টে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৯-এ শ্রপশায়ারের শ্রিউসবারিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ধনী সমাজের গন্যমান্য ডাক্তার এবং অর্থব্যবস্থাপক রবার্ট ডারউইন এবং সুজানা ডারউইন (Wedgwood বিবাহ-পূর্ব) এর ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিল। তাঁর পিতামহ এরাসমাস ডারউইন এবং জোসিয়াহ ওয়েডগউড উভয়ই বিশিষ্ট বিলোপকারী ছিলেন । ইরাসমাস ডারউইন তাঁর প্রকাশিত জুনোমিয়াতে (১৭৯৪) বিবর্তন ও সাধারণ বংশোদ্ভূতির সাধারণ ধারণাগুলির প্রশংসা করেছিলেন, পরে তাঁর প্রপৌত্রের দ্বারাই যা বিস্তার লাভ করে।
ডারউইন ১৮২৫ সালের গ্রীষ্মকালীন একজন শিক্ষানবিশ ডাক্তার হিসাবে তাঁর পিতাকে শ্রপশায়ারের দরিদ্রদের চিকিৎসা সেবা দিতে সাহায্য করেছিলেন। ১৮২৫ সালের অক্টোবরে তার ভাই ইরাসমাসের সাথে এডিনবার্গ মেডিকেল স্কুলে (সেই সময়ে যুক্তরাজ্যের সেরা মেডিকেল স্কুল) যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখেন। মেডিকেল স্কুলের বক্তৃতাগুলি ডারউইনের কাছে নিস্তেজ মনে হয় এবং শল্যচিকিৎসা বিরক্তিকর বলে মনে করেছিলেন, তাই তিনি তার পড়াশুনাকে অবহেলা করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার রেইন ফরেস্টে চার্লস ওয়াটারটনের সাথে আসা একজন মুক্ত কালো দাস জন এডমনস্টনের কাছ থেকে দৈনিক প্রায় ঘন্টার হিসেবে ৪০ দিন ধরে ট্যাক্সিডারমি শিখেছিলেন।
ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছরে, প্লিনিয়ান সোসাইটিতে যোগ দিয়েছিলেন। যা ছাত্র -ছাত্রীর একটি প্রাকৃতিক-ইতিহাসের দল। এরা প্রাণবন্ত বিতর্কের সাথে জড়িত। বির্তকের মাধ্যমে যেখানে জড়বাদী গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবাদী ধর্মীয় ধারণাগুলিকে বিজ্ঞান দিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হত। তিনি রবার্ট এডমন্ড গ্রান্টের ফরথ অফ -এ সামুদ্রিক মেরুদন্ডির শারীরবৃত্ত এবং জীবনচক্র সম্পর্কে তদন্তে সহায়তা করেছিলেন। সহয়তা করতে গিয়ে তিনি দেখেন যে ঝিনুকের খোলে পাওয়া কালো বীজগুলি আসলে ছিল স্কেট নামক জোঁকের ডিম। পরে ২৭ শে মার্চ ১৮২৭ সালে প্লিনিয়ায় তাঁর নিজস্ব আবিষ্কার উপস্থাপন করেছিলেন। একদিন, গ্রান্ট লামার্কের বিবর্তনমূলক ধারণার প্রশংসা করেছিলেন। ডারউইন গ্রান্টের দু: সাহসিকতায় অবাক হয়েছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি তাঁর দাদা ইরসমাসের জার্নালেও একই ধরনের ধারণা পড়েছিলেন। ডারউইন রবার্ট জেমসন এর প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে উদাস ছিলেন। যেখানে ভূতত্ত্বসহ নেপচুনিজম এবং প্লুটোনিজমের মধ্যে বিতর্ক হত। তিনি উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস শিখেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘরের (তৎকালীন ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম যাদুঘর) সংগ্রহের কাজে সহায়তা করেছিলেন।
চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা ও পড়াশোনায় ডারউইনের অবহেলায় তার পিতা বিরক্ত হন। তিনি তাকে খ্রিস্টের কলেজ, কেমব্রিজে পাঠান ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি লাভের জন্য যাতে করে তিনি একজন অ্যাঙ্গলিকান কান্ট্রি পারশন হতে পারেন। ডারউইন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান-বিতরণী পরীক্ষায় অযোগ্য ছিল ফলে তিনি জানুয়ারী ১৮২৮ এ সাধারণ ডিগ্রী কোর্সে যোগদান করেন। পড়াশোনার চেয়ে তিনি ঘোড়ায় চড়া ও শুটিংকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ডারউইনের তালিকাভুক্তির প্রথম কয়েক মাসের সময় তাঁর দ্বিতীয় চাচাত ভাই উইলিয়াম ডারউইন ফক্সও খ্রিস্টের চার্চে অধ্যয়নরত ছিলেন। ফক্স তাকে তার প্রজাপতি সংগ্রহের দ্বারা মুগ্ধ করেছিল, ডারউইনকে এনটমোলজির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এবং তাকে বিটল সংগ্রহের জন্য প্রভাবিত করেছিল। তিনি উদ্যোগী হয়ে এই কাজটি করেছিলেন এবং তাঁর কিছু সংগৃহিত বিটল জেমস ফ্রান্সিস স্টিফেন্সের ইলাস্ট্রেশনস অফ ব্রিটিশ এনটমোলজিতে প্রকাশিত হয়েছিল (১৮২৯–৩২)। ফক্সের মাধ্যমে ডারউইন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জন স্টিভেন্স হেনস্লো- এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং অনুগামী হয়েছিলেন। তিনি অন্যান্য অগ্রণী পারশন প্রকৃতিবিদের সাথে পরিচিত হন, যারা বৈজ্ঞানিক কাজকে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব হিসেবে দেখেন। আস্তে আস্তে তিনি বুঝতে পারেন যে এরা হেনস্লোর সাথে মিশতে পারা ডন (যুক্তরাজ্যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ফেলোশিপ প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ডন বলা হয়)। তাঁর নিজের পরীক্ষা যখন কাছাকাছি এসেছিল, ডারউইন তার পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেছিলেন এবং উইলিয়াম প্যালির খ্রিস্টধর্মের প্রমাণাদি (১৭৯৪) এর ভাষা ও যুক্তি দেখে আনন্দিত হন। ১৮৩১ এর জানুয়ারিতে তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষায় ডারউইন খুব ভাল করেছিলেন, সাধারণ ডিগ্রির জন্য ১৭৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে দশম হন।
১৮৩১ সালের জুন পর্যন্ত ডারউইনকে কেমব্রিজে থাকতে হয়েছিল। তিনি প্যালির ন্যাচারাল থিওলজি বা দেবতার অস্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যগুলির প্রমাণাদি (প্রথম ১৮০২ সালে প্রকাশ করেছিলেন) অধ্যয়ন করেছিলেন। উক্ত বইয়ে প্রকৃতির নিয়মের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের কর্ম হিসাবে অভিযোজনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। প্রকৃতির ঐশ্বরিক নকশার পক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রদান করা হয়েছিল। তিনি জন হার্শেলের নতুন বই, প্রাকৃতিক দর্শন নিয়ে স্টাডি অফ প্রিলিমিনারি ডিসকোর্স (১৮৩১) পড়েছিলেন যা প্রাকৃতিক দর্শনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যকে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বোঝার জন্য ব্যাখ্যা করেছিল। ডারউইন আরো পড়েন আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ডের বৈজ্ঞানিক ভ্রমনের ব্যক্তিগত বিবরণীমূলক বই যা আলেকজান্ডার ১৭৯৯–১৮০৪ এ ভ্রমণের উপর লিখেন। ডারউইন এরূপ অবদানের জন্য অনুপ্রাণিত হন এবং তাৎক্ষণিক গ্রীষ্মকালীন অঞ্চলে প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য স্নাতকোত্তর শেষে কিছু সহপাঠীর সাথে টেনেরিফ যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। প্রস্তুতিতে, তিনি অ্যাডাম সেজউইকের ভূতত্ত্ব কোর্সে যোগ দিয়েছিলেন, তারপরে ৪ আগস্ট ওয়েলসে মাটির স্তর শিক্ষন বিষয়ক প্রশিক্ষনের উদ্দেশ্যে পাক্ষিক সময় কাটাতে তাঁর সাথে ভ্রমণ করেছিলেন।
বিগ্ল জাহাজে যাত্রা
এইচএমএস বিগ্লের দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রা পরিচালিত হয় ইংরেজ ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিট্জ্রয় এর নেতৃত্বে। ১৮৩১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ডেভেনপোর্ট থেকে যাত্রা শুরু করে ১৮৩৬ সালের ২রা অক্টোবর ফালমাউথ বন্দরে ফিরে আসে এইচএমএস বিগ্ল। এটিই দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রা। প্রথম সমুদ্রযাত্রারও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফিট্জ্রয়। দ্বিতীয় যাত্রায় নিসর্গী তথা প্রকৃতিবিদ হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন তরুণ চার্লস ডারউইন। এই যাত্রায়ই তিনি বিবর্তনবাদের ভিত রচনা করেন। যাত্রার বর্ণনা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে ডারউইন একটি বই লিখেন যার নাম দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগ্ল।
২৭ ডিসেম্বর ১৮৩১ -এ শুরু হয়ে এ সমুদ্রসযাত্রা প্রায় পাঁচ বছর চলে এবং ডারউইন ফিটজরয়ের আকাঙ্ক্ষানুযায়ী এর প্রায় পুরোটা সময় ডাঙ্গায় ভূতাত্ত্বিক ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সংগ্রহ করে কাটান, যখন বিগল তটভূমি জরিপ করছিল। তিনি তার পর্যবেক্ষণ ও তাত্ত্বিক ধারণাগুলো যত্ন করে লিখে রাখতেন এবং নিয়মিত বিরতিতে তার সংগৃহীত নমুনা চিঠিসহ ক্যাম্ব্রিজে পাঠাতেন, যেখানে তার পরিবারকে তার লেখা দিনলিপির অনুলিপিও অন্তর্ভুক্ত হত। তার ভূতত্ত্ব, গুবরে পোকা সংগ্রহ এবং সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী ব্যবচ্ছেদ করায় দক্ষতা ছিল, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে তিনি একেবারেই নবীন ছিলেন এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্যে নমুনা সংগ্রহ করতেন।অনবরত সমুদ্রপীড়ায় ভুগলেও তিনি তার অধিকাংশ প্রাণীবিজ্ঞানগত লেখা সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী সংক্রান্ত, যার শুরু হয়েছিল ধীরস্থির প্লাংক্টন সংগ্রহের মাধ্যমে।
সেন্ট জাগোর উপকূলে তাদের প্রথম যাত্রাবিরতিকালে ডারউইন আবিষ্কার করেন আগ্নেয় শিলার উঁচু চূড়ার সাদা একটি অংশে ঝিনুক রয়েছে। ফিটজরয় তাকে চার্লস লায়েলের প্রিন্সিপালস অফ জিওলজির প্রথম খণ্ডটি দিয়েছিলেন যাতে ইউনিফির্মিটারিয়ানিজম প্রক্রিয়ায় বহু বছর ধরে ভূমির ধীরে ধীরে উঁচু হওয়া অথবা নিচু হয়ে হারিয়ে যাবার প্রক্রিয়ার উল্লেখ আছে। ডারউইন লায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন, ভূতত্ত্বের উপর একটি বই লেখার জন্যে চিন্তাভাবনা ও তত্ত্ব তৈরি করতে শুরু করেন। ব্রাজিলে গিয়ে ডারউইন নিরক্ষীয় বনভূমি দেখে মুগ্ধ হন, কিন্তু সেখানকার দাসপ্রথা তাকে ব্যথিত করে।
পাতাগোনিয়ার পুনটা আলটায় পাহাড়চূড়ায় তিনি বিশাল সব বিলুপ্ত স্তন্যপায়ীর ফসিল আবিষ্কার করেন, পাশাপাশি তিনি আধুনিক সামুদ্রিক শামুকেরও দেখা পান, সে থেকে তিনি বুঝতে পারেন এ সব প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে, বহুকাল পূর্বে কোনো মহাপ্লাবন বা অকস্মাৎ বিপর্যয়ের ফলে নয়। তিনি স্বল্প পরিচিত মেগাথেরিয়াম আবিষ্কার করেন, যার গায়ের অস্থিময় বর্ম দেখে তিনি প্রথমটায় স্থানীয় আর্মাডিলোর দানবাকার সংস্করণ ভেবেছিলেন। ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পর তার এসব আবিষ্কার রীতিমতো হইচই ফেলে দেয়। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও আরো ফসিলে অনুসন্ধান করতে তিনি স্থানীয় মানুষদের সাথে আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তিনি লায়েলের দ্বিতীয় ভল্যুমটি পড়েছিলেন এবং তার প্রজাতির সৃষ্টির কেন্দ্র ধারণাটি মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার সংগৃহীত নমুনা এবং তাদের ব্যাখ্যা লায়েলের মসৃণ অবিচ্ছিনতা এবং প্রজাতির বিলুপ্তির ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে।
first Beagle voyage|প্রথম বিগল অভিযানে ধরে আনা তিনজন ফুয়েগিয়কে এই অভিযানে সঙ্গে নেওয়া হয়। তারা একবছর ইংল্যান্ডে বসবাস করে এবং টিয়ারা ডেল ফুয়েগোতে তাদের মিশনারি হিসেবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ডারউইন তাদের বেশ মিশুক এবং সভ্য আচরণের অধিকারী মনে করতেন, কিন্তু ফুয়েগোতে তাদের আত্মীয়দের সম্পর্কে তার অভিমত ছিল করুণ, অসভ্য জংলি, গৃহপালিত পশু আর বন্য পশুর মধ্যকার পার্থক্যের মতোই ছিল সভ্য মানুষ ও তাদের ফারাক। ডারউইনের মনে হয় এ পার্থক্যের কারণ সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা, জাতিগত কোনো সীমাবদ্ধতা নয়। তার বৈজ্ঞানিক সুহৃদদের সাথে তার মতপার্থক্য গড়ে উঠতে শুরু করে, তিনি ভাবেন হয়ত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে কিছু একটা মিল আছে। এক বছর পর ফুয়েগিয়দের সভ্য করার মিশন পরিত্যাগ করা হয়। জেরেমি বাটন নামধারী ফুয়েগিয়ান স্থানীয়দের মতো জীবনযাপন করতে শুরু করে, সে ওখানেই বিয়ে করে এবং ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার কোনো ইচ্ছা তার মধ্যে দেখা যায় না।
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সূচনা
১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ডারউইন ইংল্যান্ডে ফিরে আসার আগেই, তিনি ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হয়েছিলেন কারণ নির্বাচিত প্রকৃতিবিদদের জন্য ডারউইনের ভূতাত্ত্বিক চিঠিপত্র প্রকাশ করে হেনস্লো তাঁর প্রাক্তন ছাত্রের খ্যাতি বর্ধন করেছিলেন। ১৮৩৬ সালের ২ অক্টোবর জাহাজটি কর্নওয়ালের ফালমাউথে নোঙর করে। ডারউইন তত্ক্ষণাত্ শ্রুজবারীতে তাঁর বাড়ি যাবার জন্য এবং আত্মীয়স্বজনদের দেখার জন্য দীর্ঘ কোচ যাত্রা শুরু করেছিলেন। এরপরে তিনি হেনস্লোকে দেখার জন্য কেমব্রিজের দিকে তড়িঘড়ি করে ছুটে যান। হেনস্লো তাকে ডারউইনের প্রাণীর সংগ্রহগুলি তালিকাভুক্ত করার জন্য এবং বোটানিকাল নমুনাগুলি গ্রহণের জন্য বিভিন্ন প্রকৃতিবিদদের আমন্ত্রন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ডারউইনের বাবা বিনিয়োগের আয়োজন করেছিলেন, তার পুত্রকে একটি স্ব-অর্থায়িত ভদ্রলোক বিজ্ঞানী হিসাবে সক্ষম করেছিলেন, এবং উচ্ছ্বসিত ডারউইন লন্ডনের সংস্থাগুলির কাছে গিয়েছিলেন এবং সংগ্রহগুলি বর্ণনা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সন্ধান করেছিলেন। ব্রিটিশ প্রাণিবিজ্ঞানীদের সেই সময়ে প্রচুর কাজের ঘাটতি ছিল। প্রাকৃতিক ইতিহাস সংগ্রহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বত্র উত্সাহিত হওয়ার এবং নমুনাগুলি কেবল সংরক্ষণের মধ্যেই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
চার্লস লাইল ২৯ ই অক্টোবর আগ্রহের সাথে প্রথমবারের মতো ডারউইনের সাথে দেখা করেছিলেন এবং শীঘ্রই তাকে আসন্ন শারীরবৃত্তবিদ রিচার্ড ওউনের সাথে পরিচয় করান, যিনি রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনসের ডারউইনের জীবাশ্মের হাড়ের কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। হাড়গুলো পরে চিহ্নিত করা হয় – বিশাল বিলুপ্ত স্থল স্লথ সেই সাথে মেগাথেরিয়াম (Megatherium), অজানা একটি প্রায় সম্পূর্ণ কঙ্কাল পাওয়া যায় স্কিলিডোথেরিয়াম (Scelidotherium) এবং একটি জলহস্তী আকারের তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণীর মস্তক যা টক্সোডন (Toxodon) নামক একটি দৈত্য প্রতিম ক্যাপিবারার (Capybara) সদৃশ। বর্মসদৃশ খণ্ডগুলি প্রকৃতপক্ষে গ্লিপডডনের মত একটি বিশাল আর্মাদিলো জাতীয় প্রাণীর, যেমন ডারউইন প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলেন। এই বিলুপ্ত প্রাণীগুলি দক্ষিণ আমেরিকার জীবিত প্রজাতির সাথে সম্পর্কিত ছিল।
মার্চের গোড়ার দিকে, ডারউইন এই কর্মক্ষেত্রের নিকটবর্তী হবার জন্য লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন, লাইলের বিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞদের সামাজিক সভায় যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে চার্লস ব্যাবেজের মতো বিজ্ঞানী ছিল যিনি ঈশ্বরকে আইনের প্রোগ্রামার হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। ডারউইন তাঁর মুক্তচিন্তার ভাই ইরাসমাসের সাথে ছিলেন।
অতিরিক্ত কাজ, অসুস্থতা এবং বিবাহ
এই নিবিড় অধ্যয়নের বিকাশ করার সময় ডারউইন আরও বেশি কাজে নিরস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবুও তার জার্নালে পুনরায় লেখালেখি করার পাশাপাশি তিনি তার সংগ্রহগুলি সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদন সম্পাদনা এবং প্রকাশ করতে পেরেছিলেন এবং হেনস্লোর সহায়তায় জুওলজি অব দ্যা এইচএমএস বিগলের ভয়েজ -এর এই বহু-ভলিউমের বই স্পনসর করার জন্য £১০০০ পাউন্ডের একটি ট্রেজারি অনুদান পেয়েছিলেন, যা ২০১৯ সালের হিসেবে প্রায় £৯২০০০ পাউন্ডের সমান । তিনি ভূতত্ত্ব সম্পর্কিত তাঁর পরিকল্পনামূলক বইগুলিও উক্ত তহবিলে অর্ন্তগত করেছিলেন এবং প্রকাশকের সাথে অবাস্তব তারিখগুলিতে সম্মত হন। ভিক্টোরিয়ার যুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে ডারউইন তার জার্নালটি লিখতে চাপ দিয়েছিলেন এবং ১৮৩৭ সালের আগস্টে প্রিন্টিং প্রুফ সংশোধন শুরু করেন।
ডারউইন চাপের মধ্যে কাজ করার সাথে সাথে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। ২০ সেপ্টেম্বর তিনি “হৃদযন্ত্রের অস্বস্তিকর ধড়ফড়ানিতে” আক্রান্ত হন, তাই তার চিকিত্সকরা তাকে “সমস্ত কাজ বন্ধ করে” এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য দেশে থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। শ্র্যসবারীর সাথে দেখা করার পরে তিনি স্টাফোর্ডশায়ারের মেয়ার হলে তার ওয়েডগউড আত্মীয়দের সাথে যোগ দিয়েছিলেন, তবে তারা তাঁকে অনেক বিশ্রাম দেওয়ার থেকেও তাঁর ভ্রমণের গল্পের জন্য খুব আগ্রহী ছিলেন। ডারউইনের চেয়ে নয় মাস বড় তার কমনীয়, বুদ্ধিমান এবং সংস্কৃতীবান চাচাত বোন এমা ওয়েডগউড তাঁর অক্ষম চাচীকে নার্সিং করছিলেন। তাঁর চাচা জোশিয়া একটি এলাকা দেখান যেখানে সিন্ডার (একধরনের আগ্নেয়গিরি পাথর) দোআশ মাটিতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এবং ইঙ্গিত করে বলেন যে এই কাজ কেঁচোর হতে পারে। এ থেকে ডারউইন “একটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব” সম্পর্কে উৎসাহিত হন। পরে ডারউইন মাটি গঠনে কেচোর ভূমিকার উপর জিওলজিক্যাল সোসাইটিতে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন ১ নভেম্বর ১৮৩৭ সালে।
উইলিয়াম হিওয়েল ডারউইনকে ভূতাত্ত্বিক সোসাইটির সেক্রেটারির দায়িত্ব নিতে চাপ দিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে কাজটি নিতে অস্বীকার করার পরে, তিনি ১৮৩৮ সালের মার্চ মাসে এই পদটি গ্রহণ করেন। বিগল রিপোর্টগুলি লেখার ও সম্পাদনার ঝামেলা সত্ত্বেও ডারউইন বিশেষজ্ঞ প্রকৃতিবিদদের এবং প্রশ্নহীনভাবে কৃষক এবং কবুতর ফ্যানসিয়ারদের মতো বাছাই প্রজননে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকদের জিজ্ঞাসা করার প্রতিটি সুযোগ নিয়ে ট্রান্সমিউটেশন নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে, তার গবেষণা তার আত্মীয় এবং শিশু, পরিবারের কর্মচারী, প্রতিবেশী, উপনিবেশবাদী এবং প্রাক্তন শিপমেটদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি শুরু থেকেই তাঁর অনুমানগুলিতে মানবজাতির অন্তর্ভুক্তি করেছিলেন এবং ১৮৩৮ সালের ২৮ শে মার্চ চিড়িয়াখানায় একটি ওরাংওটাং দেখে তার শিশুসুলভ আচরণের বিষয়টি টীকা নিয়েছিলেন।
এই মারাত্মক চাপের ফলে তিনি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং জুনের মধ্যেই তিনি পেটের সমস্যা, মাথা ব্যথা এবং হার্টের অসুবিধার লক্ষণগুলি দেখতে পান। তিনি শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকদিন ধরে বিছানায় শায়িত ছিলেন। এরপর থেকে সারাজীবনই, তিনি বার বার পাকস্থলীর ব্যথা, বমি বমি ভাব, গুরুতর ফোঁড়া, বুক ধড়ফড়ানি, কাঁপুনি এবং অন্যান্য উপসর্গগুলিতে ভুগতে থাকেন। বিশেষত স্ট্রেসের সময় যেমন সভাগুলিতে যোগ দেওয়া বা সামাজিক যোগাযোগের সময়। ডারউইনের অসুস্থতার কারণ অজানা থেকে যায়, এবং চিকিৎসা করার চেষ্টা করে কেবলমাত্র ক্ষণিকের সাফল্য আসে।
২৩ শে জুন, তিনি বিরতি নিয়ে স্কটল্যান্ডে “ভূতাত্ত্বিকীকরণ” করেছিলেন। তিনি তিনটি উচ্চতায় পাহাড়ের সমান্তরাল “রাস্তা” কাটা দেখতে গৌরবময় আবহাওয়ায় গ্লেন রায়ের সাথে দেখা করেছিলেন। পরে তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন যে এগুলি সামুদ্রিক উত্থিত সৈকত ছিল, তবে তার পরে মেনে নিতে হয়েছিল যে এগুলি আসলে একটি অগ্রবর্তী হ্রদের তীর ছিল।