পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর :: রোডম্যাপ প্রণয়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন দাবি
প্রান্তডেস্ক:পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে যে চুক্তি হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিয়ে ‘হতাশা’ প্রকাশ করে বক্তরা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়য়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত থাকার কারণে এ অঞ্চলে এখনো ‘স্থায়ীত্বশীল’ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
পাশাপাশি এ এলাকায় বিশেষ শাসন ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ার কারণে স্থায়ীত্বশীল, গণমুখী ও পরিবেশবান্ধব ‘উন্নয়ন’ নানাভাবে ব্যহত হচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও ফ্রান্স এম্বেসীর সহযোগীতায় ঢাকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া গতিশীল করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে এক সংলাপ’ অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ব্লাস্টের এ্যাভোকেসী সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক পার্লামেন্টারি ককাসের টেকনোক্র্যাট সদস্য জান্নাত-ই ফেরদৌসি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার রক্ষা আন্দোলনের জুয়ামলিয়ান আমলাই, ডা. অজয় চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরমের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিং, সুবর্ণভূমি ফাউন্ডেশনের পরিচালক জাহেদ হাসান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রের গনতন্ত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকতে পারে না, লোক দেখানো অর্ন্তভুক্তিমূলক হলে হবে না, গণতন্ত্র হতে হবে একটি অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং কার্যকর। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে কোনো রকম আলোচনা না করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩৭০ কি.মি. পিচ ঢালা পথ তৈরি করে দিব আমি কার জন্য? আদিবাসীদের চাওয়া পাওয়া আশা আকাঙ্খা সেটার প্রতিফলন ঘটতে হবে উন্নয়ন কর্মকান্ডে।’
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড শুধু কাঠামোগত উন্নয়ন হলে হবে না, উন্নয়ন হতে হবে মানবিকগত এবং উন্নয়ন যাদের জন্য করা হবে ও যে অঞ্চলে হবে তাদের মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে’, বলে মত তার।
মানুষ হিসেবে অধিকার বঞ্চিত নাকি অধিকার ভোগ করে সে বড় হচ্ছে, সে তার মতো করে তার কথা গুলো বলতে পারছে কিনা, অধিকার ভোগ ও আদায় করার ব্যবস্থা কেমন সেটাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে তুমি যদি আমাকে সোনায় বেধে খাচায় রেখে দাও সেটা সোনার খাচার হবে। কিন্তু আমি তো স্বাধীন মানুষ হিসেবে বাচঁতে চাই।’
অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন,‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে যদি বন্দি করে রাখবার কোনো রকম চিন্তা চেতনা থাকে রাষ্ট্রের সেটা ভুল দর্শন। এবং সেই দর্শন কখনো মানবিক উন্নয়নে সাহায্য করতে পারে না। সেটা উন্নয়ন বলে আমরা কখনো স্বীকৃতি দিতে পারব না। এই কথা গুলো রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে নূন্যতম একটা নৈতিকতা থাকতে হবে যে রাষ্ট্রকে আমরা নূন্যতমভাবে বিশ্বাস করতে পারি। আমি জানি আমার এতটুকু বিশ্বাস থাকতে হবে রাষ্ট্র আমার সাথে নাগরিক আমি অসহায় আমি নিরীহ নাগরিক আমার সঙ্গে রাষ্ট্র কখনো প্রতারনা করতে পারবে না। এতটুকু নিশ্চয়তা আমরা চাই রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই নিশ্চয়তার নূন্যতম নৈতিকতা এই রাষ্ট্রের না থাকে তাহলে সেই রাষ্ট্র কখনো সভ্য রাষ্ট্র নয়, সে রাষ্ট্র গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, সে রাষ্ট্র কখনো আধুনিক রাষ্ট্র নয়, সে রাষ্ট্র কখনো মুক্তিযুদ্ধের সোনার বাংলার রাষ্ট্র নয়, কখনো হতে পারে না। রাষ্ট্র নৈতিকভাবে কোন অবস্থানে চলে গেছে। এরকম নৈতিকতাহীন রাষ্ট্রকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই না।’
তিনি তার বক্তব্যে কয়েকটি সুপারিশ রাখেন। যেখানে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নিবার্চনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথার উল্লেখ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত শুধু উল্লেখ থাকা নয় প্রথম ৩৬৫ দিনের মধ্যে শান্তি চুক্তি যেন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয় তার একটি রোডম্যাপ এই নির্বাচনী ইশতেহারে দিতে হবে। তৃতীয়ত কমিউনিটি পুলিসিং অবিলম্বে কার্যকর করা দরকার। শুধুমাত্র পুলিশ না স্থানীয় আদিবাসী জনগনকে সম্পৃক্ত করে তাদের দ্বারা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে করতে হবে।
আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা এবং এই সমস্যা ক্রমাগত জটিল হচ্ছে। তাই এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। আমরা কি বাংলাদেশের মধ্যে উপনিবেশ তৈরি করেছি, পাকিস্তানের মতো! দেশকে তো বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে রাষ্ট্রই ঠেলে দিচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গনতন্ত্র ও বহুত্ববাদের চোখ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে দেখতে হবে। কোনো জাতিকে প্রমোশন দেওয়া যায় না, সমমর্যাদা ও সমসম্মান দেওয়া যায়। বাঙালি বানানো, মুসলমান বানানো একটি ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা। অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত রোডম্যাপ প্রণয়ন করার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য এ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন’ প্রসঙ্গে বলেন বলেন, ‘এরই মধ্যে আমি অনেকগুলো বিষয় স্টাডি করে জানতে পেরেছি। অনেক আইনের ফাক-ফোকর দিয়ে করা হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে দাড়ি, কমা দিয়ে পর্যন্ত আমাদের বিভ্রান্ত করা হয়।’
চুক্তি অবাস্তবায়ন না হওয়া ‘দু:খজনক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হবে যা চুক্তিতে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল। বিপরীতে এখনো পর্যন্ত সেখানকার আদিবাসীরা ভূমি বেদখলের শিকার হয়ে উচ্ছেদ হচ্ছে। সবচেয়ে দু:খজনক যারা চুক্তি করেছিল বা যারা চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সক্রিয় তাদের সরকার মিথ্যা মামলা, নানা রকম নিপীড়ণ নির্যাতন হয়রানির ও এলাকাছাড়া করে রেখেছে।’
সভাপতির বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক(ইডি) পল্লব চাকমা বলেন,‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ডেনমার্ক সরকারের একটা সুপারিশ ছিল একটা নিদিষ্ট সময় বেধেদিয়ে যেন চুক্তিটির বাস্তবায়ন করা হয়। সেটা বাংলাদেশ সরকার রাজি হয়েছেন। কিন্ত এটাতো ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার রাজি আছে। কিন্ত বাস্তবায়ণের প্রকৃয়ায় কতধুর সেটা আমরা জানিনা। বাংলাদেশ সরকার শুধু দেশেই নয়, আন্তজাতিক পরিমণ্ডলেও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্ত রক্ষা করতে পারছেনা। এটা সামগ্রিকভাবে সবার জন্য অনাকাঙ্খিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ভূমি কমিশন গঠন হলেও এখন পযর্ন্ত একটি ভূমি সমস্যার সমাধান হয়নি। ভূমি কমিশনে আইন হয়েছে কিন্তু আজও পযনর্ কোনো অগ্রগতি হয়নি।’
চুক্তির গুরুত্বপূর্ন মূলধারা গুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দুই পক্ষের আবার আলোচনায় বসার জন্য আহবান জানান পল্লব চাকমা।