১৭ নভেম্বর ১৯৭৬, ভাসানীর মৃত্যু সংবাদ(স্মরণ)

মযহারুল ইসলাম বাবলা::১৭ নভেম্বর, ১৯৭৬। রাত সোয়া ৮টায় ভাসানীর মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্র ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেলের তিনতলার পরিচিত কেবিনে। করিডোরে উৎসুক মানুষ আর ভাসানীর অনুসারীর ভিড়। ভিড় ঠেলে কেবিনের দরজায় ধাক্কা দিই। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজা খোলামাত্র ভেতরে ঢুকে দেখি চিরশয়ানে নিথর ভাসানী। গণমাধ্যমের ফটোসাংবাদিকদের ছবি তোলার হিড়িক। শব ট্রলিতে উঠিয়ে নিচে রওনার প্রাক্কালে ট্রলি ধরতে অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ায় ট্রলির পেছনের দিক খুলে অনভিপ্রেত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ভ্যাগিস পারভেজ ভাই (বাংলা একাডেমির সামনের সড়কে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত ইউপিপি নেতা) দ্রুত ঝাঁপিয়ে ট্রলির পেছনের অংশ তুলে না ধরলে কেলেঙ্কারি ঘটে যেত। ট্রলি ঠিক করে নিচের আউটডোরের বিশাল বারান্দায় শব রাখা হলো। রাত ১০টায় ঢাকা মেডিকেল চত্বর লোকে লোকারণ্য। সামরিক শাসনের সেই ক্রান্তিকালে অত রাতে কেউ ঘরের বাইরে থাকার সাহস করত না। কিন্তু সেদিনের রাতটি হাজারো মানুষের সরব উপস্থিতি-আহাজারিতে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। রাজনৈতিক নেতারা ছাড়াও এলেন সামরিক শাসকের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম। প্রধান সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া। সায়েম সাহেব ফাতেহা পাঠ করে পরদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে গেলেন। রাত বাড়ছে কিন্তু দর্শনার্থীর ভিড় কমছে না।
দর্শনার্থীদের সুবিধা বিবেচনা করে লাশ বারান্দার মাঝ থেকে সরিয়ে দক্ষিণ-পূর্বপাশে আনা হয়, যেন সারিবদ্ধ মানুষ লাইন ধরে ভাসানীকে দেখতে পারে। রাত ২টার দিকে দর্শনার্থী কমে এলে মরদেহ বারান্দার পশ্চিম দিকে নিয়ে চারদিকে কাপড় টাঙিয়ে শেষ গোসলের আয়োজন করা হয়। গোসলে অংশ নেওয়া মৌলভীর আহ্বানে আমিও যোগ দিই। ভাসানীকে গোসল করানোর ফাঁকে মৃত্যুর আগে লন্ডনে করা অপারেশনের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থান ধরে দেখলাম– হিমশীতল। কাফনে আবৃত করে বারান্দার মাঝখানে লাশ এনে রাখা হলো। লাশের চারপাশে বড় বড় বরফের চাঁই দেওয়া হলো। ডিউটিরত পুলিশেরা দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে। মরদেহের সামান্য দূরে বসে প্রখ্যাত শিল্পী মুস্তাফা আজিজ এঁকে চলেছেন ভাসানীর শব ও পারিপার্শ্বিক দৃশ্য। নিদ্রাচ্ছলে দেয়ালে হেলান দেওয়া পুলিশের স্কেচ শিল্পীর খাতায় দেখে কতিপয় পুলিশ তীব্র আপত্তি জানালে আমাদের প্রতিরোধে চুপ হয়ে যায়।
মৃত ভাসানীকে দেখতে আসা মানুষের ঢল উপেক্ষা করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেওয়া হয় জানাজার জন্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে জানাজা শেষে ট্রাকে করে লাশ হেলিপোর্টে রওনা হলে আমরা গাড়িতে রওনা হলাম সন্তোষ অভিমুখে। সন্তোষে দাফন শেষে শেষ বিকেলে আবার ঢাকার পথে পাড়ি দিই।
মওলানা ভাসানী শুধু সাম্রাজ্যবাদবিরোধীই ছিলেন না; সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়তায় কীভাবে লড়তে হয়, সে শিক্ষাও দিয়ে গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জরুরি।
মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত (দৈনিকসমকালের সৌজন্যে)