এখন প্রশ্ন হলো একজন লেখক কারাবন্দি হবেন কেন? এই বিষয়ে আমি দিনেমার দার্শনিক সৌরেন কিয়ের্কে গার্ড এর শরণ নেব। তিনি বলে গেছেন, সত্য প্রকাশ মানে আগুনে হাত দেওয়া। আর আগুনে হাত দেয়া মানে হাত পুড়ে যাবে। লেখকের কাজ হচ্ছে সত্য প্রকাশ করা। আর যে সমাজে রাষ্ট্রে লেখকের হাতকে আগুন থেকে বাঁচানোর রক্ষা কবচ থাকে না সেখানে লেখকেরা কারাবন্দি হয়ে থাকেন। এরকম কারাবন্দি হবার ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয়।
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস তার বড় নিদর্শন। তিনি সত্য প্রকাশ করে কারাবন্দি হয়েছেন, শেষতক মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। তবুও সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। এখানেই শেষ নয়, সত্য প্রকাশের দায়ে কাজী নজরুল ইসলামসহ কল্লোল যুগের লেখক কালি-কলমের মুরলীধর বসু এবং শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কারাবন্দী হয়েছেন। এমনকি খড়গ রবীন্দ্রনাথের দিকেও তাক করা ছিল। তবে সেই সময়ের সত্য প্রকাশের ধাঁচ আর হাল আমলের প্রবণতা এক জিনিস নয়।
উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি। পেন এর সদর দপ্তর বিলেতে। সেই বিলেতেই উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে যা করা হচ্ছে, তা তো সমর্থনযোগ্য নয়। সেখানে পেন কি আশাব্যাঞ্জক কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে? অন্যদিকে এডওয়ার্ড স্নোদেন আমেরিকায় ফেরারি আর রাশিয়ায় মতপ্রকাশের নায়ক। উদাহরণ আরো আছে। ইরাক যুদ্ধের জোরালো সমর্থক হয়েও চীনের নাগরিক লিও জিয়াবাও নরওয়ে থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর চীনে কারাবন্দি রয়েছেন দীর্ঘ বছর যাবৎ। আবার রাশিয়ার অনেক লেখক সেদেশে কারাবন্দি হয়েছেন নানা সময়ে আর ইউরোপ-আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই ঘোরটেপের রাজনীতিও প্রশ্নের বাইরে থেকে যেতে পারে না।আদতে ক্ষমতার চরিত্র হচ্ছে যতক্ষণ কর্তার মর্জি মাফিক কলম চলবে ততক্ষণ ‘আহা বেশ! বেশ!’
এরকম ‘আহা বেশ! বেশ!’ সভাকবি রাজদরবারে যেমন অতীতে ছিল, বর্তমান জামানাতেও ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষদের মর্জিকে পুঁজি করেই টিকে থাকেন আর নিজেদের অবস্থা রমরমা করেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নবজাত কর্পোরেট গোষ্ঠি। এই রকম সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশেষ বিশেষ গণমাধ্যমে সত্য প্রকাশে ‘বন্ধা’ মহল এক শ্রেণির লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীকে ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচে’। তাদের কোনও দোষ থাকে না, যেমন পুতুলের কোন দোষ থাকতে নাই। ক্ষমতাকে সালাম করে চলার প্রবণতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার একটা উদাহরণ দিব। ২০০৭-২০০৮ সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ছিলেন একজন ডাকসাইটে উপদেষ্টা। সেই সময়ে মতপ্রকাশের কী ত্রাহি অবস্থা- তা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন এবং সদরুল আমিনের কারাবন্দি জীবন আর তাদের উপর নির্যাতনের কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। সেই সময় বাংলাদেশের কোনও গণমাধ্যমে এই ঘটনার জেরে জোরালো কোন বক্তব্য বা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের ভূমিকা নিয়েছে কী? এবার একটু এগিয়ে আসি।
২০১৯ সালে এসেও কয়েকশ লেখক সাংবাদিক দুনিয়ার নানা কারাগারে বন্দিছিলেন । তার মধ্যে সব থেকে দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দি আছেন এরিত্রিয়া-সুইডিশ নাগরিক দাবিত ইসাক। তার কারাগার জীবন বিশ বছরের কাছাকাছি। দুনিয়ার কূটনীতি, রাজনীতি, ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন, জাতিসংঘ আজও কূল কিনারা করতে পারেনি। তিনি কী আদৌ বেঁচে আছেন? এই প্রশ্নের উত্তরটাও কেউ দিতে পারেনি এখনো পর্যন্ত। তার রেখে যাওয়া শিশুসন্তান আজ শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে সাবালক জীবনে পদার্পণ করেছেন বাবার কোন খবর এবং দর্শন ছাড়াই।
কারাবন্দি লেখক দিবস উপলক্ষে আরো একটি সত্য মনে করিয়ে দিতে চাই। আদতে লেখক হওয়া মানেই বিবেক আর সত্যের কাছে বন্দি হওয়া। মানবিকতা একজন লেখকের ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় ইঙ্গিত করেছেন, লেখকও কখন কখনও দেশপ্রেমিক নাও হতে পারেন, তবে মানবিক তাকে হতে হয়।
আমার উত্তরটা ছিল এরকম- নোবেলজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস ফেইসবুক ব্যবহার করতেন না। তার এক নাতির ফেইসবুকে বন্ধুর সংখ্যা ছিল ৬২৫। এ প্রসঙ্গে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন যার ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা ৬২৫ জন, আসলে তার কোন বন্ধু নাই। আসল কথা হল একজন লেখক সামাজিক নাও হতে পারেন, তাঁকে মানবিক হতেই হবে।
কারাবন্দি লেখক দিবসে আরো কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। কারাগার হচ্ছে একজন লেখকের এক ধরনের সুযোগও বটে। তার মানে এই নয় আমি একজন লেখককে কারাগারে ঢুকে যেতে বলব। এই কারাগারে ঢুকেই কারো কলমে বেরিয়ে আসে দুনিয়ার ধ্রুপদি সাহিত্যের অনন্য সৃষ্টি। উদাহরণ- কারাবন্দি জওহরলাল নেহেরু তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন সেগুলোর সঙ্কলন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজ নামচার কথা উল্লেখ করতে চাই।আবার কেউ কেউ কারাগারে ঢুকে লেখক হয়ে বের হয়। উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় দলিত লেখক মনোরঞ্জন বেপারী।
এবার আরবি ভাষাভাষী দুনিয়ার জনপ্রিয় কবি আমার বন্ধু ফরাজ বাইরাকদারের কারাবন্দি জীবনের গল্প বলেই লেখাটি শেষ করব। ফরাজ দীর্ঘ চৌদ্দ বছর দামেস্কের জেলে বন্দি ছিলেন। তাঁর অপরাধ তার লেখালেখিতে, কবিতা ও গদ্যে সাম্যবাদের চেতনার প্রভাব প্রতীয়মান হয়েছিল। কারাগারে তাঁর পড়াশোনা আর লেখালেখি নিষিদ্ধ ছিল। তবে ছবি আঁকা আর সিগারেট খাওয়ার অনুমতি ছিল। তাঁকে কাগজ আর বই সরবরাহ করা হত না।
শেষে তিনি সিগারেটের কাগজে কাব্যচর্চা চালিয়ে গেলেন। আর ছবি আঁকার ছলে শিশুসুলভ ছবি আঁকলেন। ছবির ফ্রেমের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেটের প্যাকেটে লেখা কবিতা কারাগার থেকে বাইরে পাচার করা শুরু করলেন। তিনি ছবিগুলো আঁকতেন তাঁর মেয়ের জন্যে। তাঁর মেয়ে কারাগারে দেখা করতে গেলে ফ্রেমে বাঁধাই ছবিগুলো দিতেন আর মেয়েকে বলে দিতেন ছবিগুলো যতœ করে রক্ষা করতে। তিনি ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চাপে জেলখানা থেকে ছাড়া পান। একই সঙ্গে কবিতাগুলোও ছবির কাঠামোর ভেতর থেকে বের করলেন। কারাগারের ‘অন্ধপ্রকোষ্ট ১৩ থেকে পত্র নামে’ বই আকারে প্রকাশ পেল। বইটি আজ নানা ভাষায় অনূদিত আর সমাদৃত। তাঁর এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে নাটক ও প্রামান্যচিত্র। সেই ফরাজের কারাবন্দী জীবন নিয়ে কোন খেদ নাই। ফরাজের কাছে জীবনের পুরোটাই এক পরম সৌভাগ্য, এমন কি চৌদ্দ বছরের কারাবন্দী জীবনও। ফরাজের ভাষ্য জীবন তো এমনই।