পীরের বিরুদ্ধে সংবাদ ঠেকাতে ১০ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা
ডয়চে ভেলে::রাজারবাগ দরবার শরীফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সংবাদ ঠেকাতে মামলাকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এ পর্যন্ত ১০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইনে মামলা করেছেন পীরের অনুসারীরা।সর্বশেষ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভিতে সংবাদ প্রকাশ করায় নিজস্ব প্রতিবেদক অধরা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চট্টগ্রামে মামলা হয়েছে। এছাড়া নাগরিক টিভির সিনিয়র রিপোর্টার ফারাহ হোসাইন বিলকেসকেও রিপোর্টের কারণে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিক অধরা ইয়াসমিনকে হয়রানি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি যৌথ চিঠি পাঠিয়েছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ১৯টি দেশি ও বিদেশি সংগঠন। এছাড়া বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মানববন্ধন ও সমাবেশ করে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
গত ২৯ এপ্রিল ‘হালাল মামলার ফাঁদ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রচার করে আরটিভি। প্রতিবেদনে রাজধানীর রাজারবাগ দরবার শরীফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলাবাজি, সারাদেশে অসংখ্য মানুষকে হয়রানি, জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অধরার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন রাজারবাগ পীরের সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান সহযোগী শাকেরুল কবির। যিনি মামলা করেছেন তার বিরুদ্ধেই মামলাবাজি, জমি দখল, নারীপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে তাকে কয়েকবার কারাবাসও করতে হয়েছে।
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা সিআইডির পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “মামলার ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বেস্তামী থানা এলাকায়। বাদীর বাড়ি নোয়াখালীতে। এজন্য হয়ত এখানে তদন্তে আসছে। গত জুন মাসে মামলার নথি হাতে পেয়েছি। বিবাদীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। মামলাটি এখন তদন্ত পর্যায়ে আছে। কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই রিপোর্ট দেওয়া হবে।”
মামলার পাশাপাশি অধরা ইয়াসমিনকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে অধরা ইয়াসমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “২৯ এপ্রিল রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেটের অপকর্ম নিয়ে অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদন করেছিলাম। সে সময় নিউজটা নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছিল। রাজারবাগের পক্ষ থেকেও নিউজ না করার জন্য খুব চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু নিউজ হওয়ার পর রাজারবাগ দরবার শরীফের মুরিদ মামলাবাজ সিন্ডিকেটের মূলহোতা শাকেরুল কবির মামলাটি করেছে। এরপর থেকে ওরা আমাকে ফলো করেছে দীর্ঘদিন। আমি স্কুটি চালাই। ডানে ফাঁকা থাকার পরও অনেক গাড়ি আমাকে বামে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ফলে অনেকদিন আমি স্কুটি চালাইনি। পাবলিক বাসে যাতায়াত করেছি। সেখানেও একদিন বাস থেকে নামার পর দুইজন লোক পেছন থেকে হুমকি দিয়ে চলে যায়। এভাবে ওরা অনেকদিন ধরে আমাকে হয়রানি করেছে। সব প্রমাণাদি নিয়ে আমি সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছি, যার সব ডকুমন্টে আমি সিআইডিকে দিয়েছি।”
হাইকোর্টের আদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও সিআইডি পীরের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। আদালতে দাখিল করা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের রিপোর্টে পীরের কার্যক্রমের সঙ্গে জঙ্গি কার্যক্রমের সাদৃশ্য থাকার কথা বলা হয়েছে।
অধরার বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পরই রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সার্ক ফোয়ারা মোড়ে ‘আমরা গণমাধ্যমকর্মী’ ব্যানারে এক মানববন্ধন হয়। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, “সরকার বলছে, দেশের গণমাধ্যম সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে। দেশের গণমাধ্যম এই অর্থে স্বাধীনতা ভোগ করছে যে, আগে চ্যানেল ছিল ১টি বা ২টি, সেখানে এখন ৪০টি চ্যানেল এবং সংবাদপত্র ১ হাজার ২০০টিরও বেশি। সংখ্যার দিক থেকে স্বাধীনতা ভোগ করছে। কিন্তু গুণ ও মানের দিক থেকে এখনো সংকোচন নীতি চলছে।”
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিট (ডিআরইউ)-র সভাপতি মোরসালিন নোমানী বলেন, “রাজারবাগের পীর ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন। এই পীরের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। তিনি সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে এই পীরের অপকর্ম তুলে ধরতে। অথচ এখন মামলা দেওয়া হচ্ছে।”
পীরের দুর্নীতি নিয়ে গত ২৩ ও ২৪ আগস্ট দুই পর্বের রিপোর্ট করেছেন নাগরিক টিভির সিনিয়র রিপোর্টার ফারাহ হোসাইন বিলকিস। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “রিপোর্ট করতে গিয়েই আমি তাদের হুমকির মধ্যে পড়ি। আমার ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে আমার অফিসে এসে নিউজ বন্ধ করার জন্য ঊর্ধ্বতনদের চাপ দেয়। তারপরও নিউজ দু’টি অনএয়ার হয়েছে। যেদিন প্রথম নিউজটি এসেছে, সেদিন রাতে আমি আমার ফেসবুকে ও ম্যাসেঞ্জারে ঢুকতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কেউ হ্যাক করার চেষ্টা করছে। আর আমি আগে থেকেই জানি পীরের বিরুদ্ধে নিউজ করলে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। তাই নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে থানায় জিডি করে রেখেছি।”
তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও হুমকি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন পীরের মুখপাত্র মাহবুব আলম আরিফ। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “পীর তো কারও বিরুদ্ধে মামলা করেন না। এখন তার কোনো অনুসারী যদি ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেন তাহলে তিনি কী করবেন? অধরার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, সেটা করেছেন শাকেরুল কবীর। তিনি এখন পীরের কাছে খুব বেশি আসেন না। শাকেরুলের এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। সেই বিরোধে তারা মামাতো-ফুফাতো দুই ভাই ১৫টি মামলা করেছেন। এর সঙ্গে পীরের সম্পর্ক নেই। শাকেরুলের মামাতো ভাই একরামুল আহসান কাঞ্চন যুবদল করে। জামায়াতের শেল্টারে থাকে সে। আর আমাদের পীর তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। তার পত্রিকায় (আল ইহসান) যুদ্ধপরাধীদের বিচারের পক্ষে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আর ফারাহ হোসাইনের সংবাদের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।”
প্রধানমন্ত্রীকে ১৯ সংগঠনের চিঠি
সাংবাদিক অধরা ইয়াসমিনকে হয়রানি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন বন্ধে উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ১৯টি দেশি ও বিদেশি সংগঠন। রাজধানীর রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় আরটিভির নিজস্ব প্রতিবেদক অধরা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে। এতে ইয়াসমিনসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চা করায় যাদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের আহ্বানও জানানো হয়েছে। গত বুধবার চিঠিটি কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে,আমরা তথ্য পাচ্ছি যে, রাজারবাগ দরবার শরিফের সদস্যরা জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ইয়াসমিনের ওপর বে-আইনি নজরদারি চালাচ্ছে। ক্রমাগত তাকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেদনের কারণে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ দায়ের করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের উচিত এই হুমকির বিষয় তদন্ত করা এবং অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা এবং ইয়াসমিনের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘প্রতিবেদনটিতে সাক্ষাৎকারদাতা একরামুল আহসান কাঞ্চনকেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ইয়াসমিনের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে। তা প্রত্যাহার করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
যৌথ চিঠিতে স্বাক্ষরকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, আর্টিকেল ১৯ দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, বাংলাদেশি জার্নালিস্টস্ ইন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া (বিজেআইএম), ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, কোয়ালিশন ফর উইম্যান ইন জার্নালিজম (সিএফডব্লিআইজে), কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), ফোরাম ফর ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন বাংলাদেশ, ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড, আইএফইএক্স, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ), পেন আমেরিকা, পেন বাংলাদেশ, পেন ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এবং রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস।
(জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সমীর কুমার দে। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের)