আজসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল জব্বার’র৬ষ্ট মৃত্যু বার্ষিকী
প্রান্তডেস্ক:আব্দুল জব্বার ( ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮ – ৩০ আগস্ট, ২০১৭) একজন বাংলাদেশি সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত সালাম সালাম হাজার সালাম, জয় বাংলা বাংলার জয় সহ অনেক উদ্বুদ্ধকরণ গানের গায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তার গাওয়া তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়, সালাম সালাম হাজার সালাম ও জয় বাংলা বাংলার জয় গান তিনটি ২০০৬ সালে মার্চ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়।এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দুটি সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক (১৯৮০) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৯৬) ভূষিত হন।
প্রাথমিক জীবন
আব্দুল জব্বার ১৯৩৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন ওস্তাদ ওসমান গনি এবং ওস্তাদ লুৎফুল হকের নিকট।
কর্মজীবন
জব্বার ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ১৯৬২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র সংগমের গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে এতটুকু আশা ছবিতে সত্য সাহার সুরে তার গাওয়া “তুমি কি দেখেছ কভু” গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। একই বছর ঢেউয়ের পর ঢেউ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে “সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো” গানে কণ্ঠ দেন। রবীন ঘোষের সুরে তিনি পীচ ঢালা পথ (১৯৭০) ছবিতে “পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি” এবং নাচের পুতুল (১৯৭১) ছবির শিরোনাম গান “নাচের পুতুল”-এ কণ্ঠ দেন।
১৯৭৮ সালে সারেং বৌ চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে “ও..রে নীল দরিয়া” গানটি দর্শকপ্রিয়তা পায়।২০১৭ সালে এই সঙ্গীত শিল্পীর প্রথম মৌলিক গানের অ্যালবাম কোথায় আমার নীল দরিয়া মুক্তি পায়।অ্যালবামটির গীতিকার মোঃ আমিরুল ইসলাম, সুরকার গোলাম সারোয়ার। একই বছরে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা গানের অ্যালবামের কাজ শুরু করেন। গীতিকার আমিরুল ইসলাম রচিত ” বঙ্গবন্ধু দেখেছি তোমায় দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ ” শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দেয়ার আগেই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে অ্যালবামের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণা যোগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালাম সালাম হাজার সালাম ও জয় বাংলা বাংলার জয়সহ অংসখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।তার গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া যুুদ্ধের সময়কালে তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন।তৎকালীন সময়ে কলকাতাতে অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ঘুরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন যা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে সেসময় বিভিন্ন সময় গণসঙ্গীত গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ রুপি দান করেছিলেন।
পারিবারিক জীবন
আব্দুল জব্বারের প্রথম স্ত্রী গীতিকার শাহীন জব্বার যার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্দুল জব্বার, সুবীর নন্দী, ফাতেমা তুজ জোহরার মত জনপ্রিয় বাংলাদেশি সঙ্গীতশিল্পীরা। তাদের সন্তান মিথুন জব্বারও একজন সঙ্গীতশিল্পী। জব্বারের দ্বিতীয় স্ত্রী রোকেয়া জব্বার মিতা যিনি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
ডিস্কোগ্রাফি
প্লেব্যাক
- সংগম (১৯৬৪)
- নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭)
- উলঝন (১৯৬৭)
- এতটুকু আশা (১৯৬৮)
- ঢেউয়ের পর ঢেউ (১৯৬৮)
- ভানুমতি (১৯৬৯)
- ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০)
- পীচ ঢালা পথ (১৯৭০)
- দীপ নেভে নাই (১৯৭০)
- বিনিময় (১৯৭০)
- জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
- নাচের পুতুল (১৯৭১)
- মানুষের মন (১৯৭২)
- স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা (১৯৭৩)
- ঝড়ের পাখি (১৯৭৩)
- আলোর মিছিল (১৯৭৪)
- সূর্যগ্রহণ (১৯৭৬)
- তুফান (১৯৭৮)
- অঙ্গার (১৯৭৮)
- সারেং বৌ (১৯৭৮)
- সখী তুমি কার (১৯৮০)
- কলমিলতা (১৯৮১)
অ্যালবাম
- কোথায় আমার নীল দরিয়া (২০১৭)
পুরস্কার ও সম্মাননা
- বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক (১৯৭৩)
- একুশে পদক (১৯৮০)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬)
- বাচসাস পুরস্কার (২০০৩)
- সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস – আজীবন সম্মাননা (২০১১)
- জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার
মৃত্যু
জব্বার ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে কিডনি, হার্ট, প্রস্টেটসহ বিভিন্ন জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ১ আগস্ট নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়।[১৮] ৩০ আগস্ট তিনি এই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।