দূর গগনে গণবন্ধু
প্রান্তডেস্ক: মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, জাতীয় ওষুধ নীতি বাস্তবায়নের লড়াই থেকে রাজনীতির আন্দোলনে শামিল হয়ে গণবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন যে মানুষটি, সেই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার নিজের প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক মামুন মোস্তাফী রাত পৌনে ১২টার দিকে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ডা. জাফরুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কিডনি সমস্যার পাশপাশি লিভারের সমস্যাও দেখা দেয় তার। এ ছাড়া তিনি অপুষ্টিসহ সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে ভারতের আগরতলায় গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন। লন্ডনে রয়্যাল কলেজ অব সার্জনসে এফআরসিএস পড়ার সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। চূড়ান্ত পর্ব শেষ করার জন্য আর সেখানে ফিরে যাননি। ফিল্ড হাসপাতালেই অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করেন। যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তার এ অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭২ সালে দরিদ্র মানুষের সেবায় ঢাকার অদূরে সাভারে গড়ে তোলেন একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। পরে যা গণস্বাস্থ্য নামে সুবিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে দীর্ঘ ৫১ বছর দেশের গরিব অসহায়দের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে তার গড়া প্রতিষ্ঠান। তিনি হয়ে ওঠে মানবতার ফেরিওয়ালা।
১৯৮২ সালে তার উদ্যোগে জাতীয় ওষুধ নীতি ঘোষণা করা হয়। এ অবদানের জন্য জানুয়ারি মাসে লন্ডনভিত্তিক সংগঠন ‘ব্রিটানিয়া ইকোনমিকাল সাপোর্ট ট্রাস্ট’ থেকে সম্মাননা পান তিনি।
স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন গণমানুষের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের করেছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী। প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসা নীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। সরকার ও রাষ্ট্রের, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন বুক চিতিয়ে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, অনিশ্চিত, তখনই বিবদমান পক্ষের মাঝখানে সমঝোতার সেতুর ভূমিকা নিয়েছেন।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রামন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসেবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রেখে চলছিলেন। তবে এ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তার।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোকে একমঞ্চে এনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এ মানুষটিকে বলা হতো কর্মবীর। অসুস্থ অবস্থায় হুইল চেয়ারে চড়েই হাজির হয়ে যেতেন প্রতিবাদী আয়োজনে কিংবা মানুষের কোনো সেবামূলক কাজে।
ডা. জাফরুল্লাহর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। বাবা-মায়ের ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরীর শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী কলকাতা ও ঢাকার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী।
ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে কান্নার রোল পড়ে যায় গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। এ সময় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্টাফরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বজন, দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষীরা হাসপাতালে ছুটে যান। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে রেখে গেছেন। তার স্ত্রী শিরীন হক একজন বিশিষ্ট নারীনেত্রী।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের, গণফোরামের একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। ( সৌজন্যে:দৈনিকদেশরূপান্তর)

