- প্রচ্ছদ
- আন্তর্জাতিক
- আজ সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর কবি, গীতিকার নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক সিকানদার আবু জাফরের জন্মদিন
আজ সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর কবি, গীতিকার নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক সিকানদার আবু জাফরের জন্মদিন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ মার্চ, ২০২৩ ১২:২২ অপরাহ্ণ | সংবাদটি ৬৮ বার পঠিত
নূর মোহাম্মদ নূরু: যাঁদের স্মৃতি আমাদের উদ্বেলিত করে তাঁদের মধ্যে সিকানদার আবু জাফর অন্যতম। যিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশাল অধ্যায় রচনা করেছেন। সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে কবি,গীতিকার, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং সর্বোপরি সাংবাদিক। সাহিত্যিক হিসেবে সিকানদার আবু জাফর যতোটা প্রসিদ্ধ ছিলেন তারচেয়ে বেশি ছিলেন একজন পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সিকানদার আবু জাফর বিশাল অধ্যায় রচনা করেছেন। আমরা যে মুক্তবুদ্ধির স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি তারমূলে ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর এবং তাঁর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকার নানা উদ্দীপনামূলক নিবন্ধ। তার একটি বিখ্যাত কবিতা হলোঃ জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে বাঁচবার অধিকার কাড়তে দাস্যের নির্মোক ছাড়তে অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ চলবেই চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই। এটি পরে জনপ্রিয় গণসঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়াও তার আর একটি বিখ্যাত কবিতা বাংলা ছাড়:
রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলো
আজকে যখন হাতের মুঠোয় কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি
কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে কেউটে সাপের ঝাপি
আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি
তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া
তুমি বাংলা ছাড়ো।
সাহিত্যাঙ্গণের এই কৃতি পুরুষের আজ ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১৯ সালের আজকের দিনে তিনি খুলনার সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কবির জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা। সিকানদার আবু জাফর ১৯১৮ সালের ১৯ মার্চ খুলনার সাতক্ষিরা জেলার তেতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাশেম ছিলেন একজন কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী। স্থানীয় বি ডি ইংরেজী স্কুল হতে প্রবেশিকা পাশ করে কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন এবং কিছুকাল এ কলেজে অধ্যয়ন করেন। সিকানদার আবু জাফর ছাত্রজীবনেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং সেই সঙ্গে সাংবাদিকতার প্রতি আকৃষ্ট হন। কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৪১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত কলকাতার ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পঞ্চাশের দশকে রেডিও পাকিস্তানের শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৮-৫৩ পয্যন্ত তদানিন্তন রেডিও পাকিস্তানে স্টাফ আর্টিষ্ট ছিলেন । এরপর ১৯৫৩ সালে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর সহযোগী সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে ‘দৈনিক মিল্লাত’-এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে আজীবন দেশের প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম মূখপাত্র সমকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন । ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’-এর প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর সমকাল পত্রিকা ব্যবহার করতেন দেশ ও জাতির কল্যাণে। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি ত্রিশোত্তর ধারার প্রগতিশীল মুক্ত সাহিত্য ধারার বিকাশ, আন্দোলন এবং নতুন লেখক সৃষ্টিতে প্রেরণা দান করেন । শুধু সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, সাহিত্য পত্রিকা মাসিক সমকাল-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবেও সিকানদার আবু জাফরের অবদান স্মরণীয়। একজন বিপ্লবকামী কবি হিসেবে অসংখ্য গণসঙ্গীত লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তার রচিত নাটক সিরাজউদ্দৌলা সারা বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিদ্রোহী কবি নজরুলের পরে সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন নজরুল চরিত্রের দ্বিতীয় একজন। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম নয় তাঁর রচিত গান বাঙালির সকল মুক্তির সংগ্রামেই প্রেরণা যুগিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এবং সাহসী সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর সময় দ্বারা আন্দোলিত হয়েছিলেন এবং তাঁর লেখার মাধ্যমে জনসাধারণকে উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা বাঙালি জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ পত্রিকার মাধ্যমে নবীন লেখকেরা দাঁড়াতে শিখেছে। তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্যের উন্নত ধারায় যেসব গুণীসাহিত্যিকের কথা স্মরণে আসে তাঁদের মধ্যে সিকানদার আবু জাফর অন্যতম। তিনি আমাদের সাহিত্যাঙ্গণের ভিত রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি চর্চার যে ধারা প্রবাহিত হয় সিকানদার আবু জাফর ছিলেন তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ নিয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। একজন বিপ্লবকামী কবি হিসেবে অসংখ্য গণসঙ্গীত লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তার রচিত গান ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। আদ্যোপান্ত বাঙালি সিকানদার আবু জাফর ছিলেন স্বাধীনতার জন্যে উদগ্রীব একজন মানুষ। তাঁর কবিতায় যুগ যন্ত্রণা বলিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়। তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য সাহসের অধিকারী একজন মানুষ যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত ‘বাঙলা ছাড়ো’ কবিতায়। সিকান্দার আবু জাফরের রচিত অনধীক ২৭ খানি গ্রন্থের মধ্যে কবিতা গ্রন্থঃ ‘প্রসন্ন প্রহর (১৯৬৫),বাংলা ছাড় (১৯৭২),বৈরীবৃষ্টিতে, তিমিরান্তক, কবিতা ১৩৭২, বৃশ্চিক লগ্ন মালব কৌশিক,
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা, শকুন্ত উপাখ্যান, মহাকবি আলাওল ইত্যাদি।
উপন্যাসঃ মাটি আর অশ্রু, পূরবী, নতুন সকাল ইত্যাদি।
গল্প গ্রন্থঃ মতি আর অশ্রু। কিশোর উপন্যাস : জয়ের পথে, নবী কাহিনী ইত্যাদি।
অনুবাদঃ রুবাইয়াৎ ওমর খৈয়াম, সেন্ট লুইয়ের সেতু, বারনাড মালামুডের জাদুর কলস, সিংয়ের নাটক ইত্যাদি এবং গানের মধ্যে মালব কৌশিক উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৬ সালে তিনি নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ব্যক্তিজীবনে দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন চরম উদ্যমী একজন মানুষ। তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল দেশপ্রেম। তিনি ছিলেন আমাদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। দৃপ্ত কণ্ঠের অধিকারী সিকানদার আবু জাফর এমন একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন যেখানে লেখার জন্যে তৎকালীন তরুণ লেখকেরা স্বপ্ন দেখত। তাঁর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা আমাদের নবীন সাহিত্যিকদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলে। সিকানদার আবু জাফর অনেক লেখক তৈরি করেছেন যারা আজ সাহিত্যাঙ্গণে খুবই পরিচিত। সিকানদার আবু জাফর ১৯৭৫ সালের ৫ আগষ্ট ঢাকার পি জি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সাহিত্যাঙ্গণের এই কৃতি পুরুষের আজ ১০১তম জন্মবার্ষিকী। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কবির জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।