বুদ্ধদেব বসু: কবিদের অভিভাবক
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:: , লেখক ও সাংবাদিক বিশ শতকের বাঙালি কবি বুদ্ধদেব বসু। ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর কুমিল্লায় তাঁর জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তাঁর প্রভাবের বাইরে এসে যারা লেখালেখি করেছেন; তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্য সমালোচনার দিকপাল, কবিতা পত্রিকার প্রকাশ ও সম্পাদনার জন্য তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত। এ ছাড়াও তিনি একজন বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদকও ছিলেন।
ফলে বাংলা কবি ও কবিতার আলোচনায় বুদ্ধদেব বসুর নাম অবধারিত। বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টির যে প্রয়াস তিরিশের কবিদের মধ্যে দেখা যায়, বুদ্ধদেব বসু সেই ধারার অন্যতম কাণ্ডারি। আধুনিক বাংলা কবিতা বিশ্লেষণের অন্যতম নায়কও বুদ্ধদেব বসু। সমালোচনাও যে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে, বুদ্ধদেব বসু তা যুক্তিনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার প্রবন্ধ পড়ার সময় পাঠক একটি বোধ পাবেন। সেই বোধ পাঠককে বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তুলবে। তবে তার রচনার সংহতি পরিমিতি এবং বস্তুনিষ্ঠতা প্রবল। চিন্তা ও আবেগের ক্রিয়াকলাপ অন্য সমালোচকের লেখায় অনুভব করা যায় না।
আধুনিক কবিদের অনেকেই জনপ্রিয়তার আড়ালেই থেকে যেতেন। যদি না বুদ্ধদেব বসু একা তাদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে না নিতেন। বিশেষ করে জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস চেষ্টা করে গেছেন তিনি। বুদ্ধদেব বসু বারবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, নতুন এই কবিকে। তেমনই আরও অনেক কবিকে তিনি তুলে ধরেছেন তার লেখায়। সেসবের সমষ্টিই তার বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কালের পুতুল’।
কালের পুতুল ১৯৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এতে প্রথম চৌধুরী, দীনেশরঞ্জন দাশ, জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অমিয় চক্রবর্তী, নিশিকান্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, ফাল্গুনী রায়, সুকুমার সরকার, নজরুল ইসলাম, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রমুখের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। এতে বুদ্ধদেব বসুর লেখা বিভিন্ন সময়ের ২৫টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।
প্রথম প্রবন্ধ ‘লেখার ইস্কুলে’ তিনি বলেছেন, ‘মম’র মতে সাহিত্যিকের পক্ষে হাসপাতালের মতো চমৎকার ইস্কুল আর হয় না, প্রত্যেক নবীন ঔপন্যাসিককে যদি হাসপাতালে বছরখানেক কাজ করানো যায়, তাহলে তাঁদের পক্ষে ভালো বই লেখা অনেকটা সুসাধ্য হতে পারে।’ (পৃষ্ঠা ২৩) তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর প্রধান লেখকেরা অনেকেই অজস্র লিখেছেন; আর সেটাই তো স্বাভাবিক, কেননা সাধারণ নিয়ম হিসেবে বলা যায় যে রচনা পরিমাণে বেশি না-হলে সমসাময়িক সাহিত্যে ও সমাজে তাঁর প্রভাব ব্যাপক কিংবা গভীর হতে পারে না।’ (পৃষ্ঠা ২৪) তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সাহিত্যের শ্রেণীবিভাগে অভ্যস্ত; বিশেষ-কোনও শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত না-হলেই সে বইকে আমরা মনে মনে ‘বাজে’ আখ্যা দিয়ে থাকি। সেইসঙ্গে জনপ্রিয়তাকে সন্দেহের চোখে দেখাও আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে, যদিও এটাও দেখি যে প্রত্যেক শ্রদ্ধেয় লেখকেরই কালক্রমে পাঠকসংখ্যা বেড়ে চলে।’ (পৃষ্ঠা ২৫)
প্রথম চৌধুরীর জয়ন্তী-উৎসব উপলক্ষে লিখেছেন ‘প্রথম চৌধুরী ও বাংলা গদ্য’। তার মতে, ‘চলিতভাষার প্রতিষ্ঠা প্রমথ চৌধুরীর মহৎ কীর্তি হলেও একামাত্র, এমনকি প্রধান কীর্তিও নয়। তাঁর সম্বন্ধে সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে গদ্যে তিনি অনিন্দ্য শিল্পী। ভালো স্টাইলের অধিকারী না-হয়েও ভালো গল্পলেখক বা ঔপন্যাসিক হওয়া যায়—যদিও প্রাবন্ধিক হয়তো হওয়া যায় না, যদি-না আমরা প্রবন্ধ বলতে শুধু তথ্যবহ রচনা বুঝি।’ (পৃষ্ঠা ৩৫) ‘প্রথম চৌধুরী’ শিরোনামে অপর প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘শরৎচন্দ্রের আর প্রথম চৌধুরীর অভ্যুত্থান প্রায় একই সময়ে; সহযাত্রী তাঁরা, কিন্তু এক যাত্রায় পৃথক ফলের এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ যদি থাকে সেটি খুঁজে পাওয়া যাবে প্রাথমিক জীবনচরিতেই। প্রমথনাথ রায়চৌধুরী ও চিত্তরঞ্জন দাশ, এই দুই নবীন ব্যারিস্টার একই দিনে প্রথম হাইকোর্টে পদার্পণ করলেন; চিত্তরঞ্জন সোজা উঠে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে, আর প্রমথনাথ হোঁচট খেয়ে সেই যে ফিরলেন; জীবনে আর ওমুখো হলেন না।’ (পৃষ্ঠা ৩৯)
‘কল্লোল’ ও দীনেশরঞ্জন দাশ’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘‘কল্লোল’-সম্পাদনা ছাড়া আর কোনও কাজ তিনি করতেন না, তাতেই দিয়েছিলেন তাঁর সময়, সম্বল ও উদ্যম, এবং ‘কল্লোলে’র আয়ু ঠিক তখনই ফুরিয়ে এলো, যখন সদ্য-আগত দিশি সিনেমার আকর্ষণ তাঁর সময় ও মনোযোগ অনেকাংশে অধিকার করে নিলে।’ (পৃষ্ঠা ৪২) আমরা জানি, কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রকৃতির কবি হিসেবে প্রধান। কারণ তার কবিতার প্রধান বিষয়ই ছিল প্রকৃতি। যত কবিতা ও গান তিনি লিখেছেন তার বেশিরভাগই ঋতু বা প্রকৃতি সংক্রান্ত। তার উপলব্ধিও প্রকৃতির মধ্যদিয়ে। একথা বুদ্ধদেব বসু অকপটে স্বীকার করেছেন। তবুও তিনি ‘জীবনানন্দ দাশ : ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে একজনকে এই বিশেষ অর্থে প্রকৃতির কবি বলা যায় : তিনি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর নব প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পড়ে এই কথাই আমার মনে হল। অবশ্য এই বইয়ের কবিতাগুলো আমার পক্ষে নতুন নয়।’ (পৃষ্ঠা ৪৭)
তিনি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘জীবনানন্দ দাশকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি বলে মনে করি।’ এ ছাড়াও তিনি ‘জীবনানন্দ দাশ : বনলতা সেন’ ও ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’ শিরোনামে দুটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। বলতে গেলে জীবনানন্দকে তিনিই কেবল মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘বাংলা কাব্যের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আসনটি ঠিক কোথায় সে-বিষয়ে এখনই মনস্থির করা সম্ভব নয়, তাঁর কোনও প্রয়োজনও নেই এই মুহূর্তে; এই কাজের দায়িত্ব আমরা তুলে দিতে পারি আমাদের ঈর্ষাভাজন সেইসব নাবালকদের হাতে, যারা আজ প্রথমবার জীবনানন্দ’র স্বাদুতাময় আলো-অন্ধকারে অবগাহন করছে।’ (পৃষ্ঠা ৭৪)
‘সমর সেন : কয়েকটি কবিতা’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘সমর সেনের কবিতায় এই বিদ্রোহের ভাব ও ভঙ্গি সুস্পষ্ট। প্রথমে রীতির কথা বলি। তাঁর কবিতা গদ্যে রচিত, এবং কেবলই গদ্যে। আমার ধারণা ছিল গদ্যরচনায় ভালো দখল থাকলে তবেই গদ্যকবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য আসে, কিন্তু সমর সেনের মধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখলুম। তিনি গদ্যে ছাড়া লেখনেনি, এবং কখনও লিখবেন এমন আশাও আমার নেই।’ (পৃষ্ঠা ৭৬)
সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়েও তিনি তিনটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন এ গ্রন্থে। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : অর্কেস্ট্রা’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : ক্রন্দসী’ ও ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা’ শিরোনামে এ তিনটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে বইটিতে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি এরকম—‘স্বতঃস্ফূর্ত গীতিকবি হিসেবে দেখতে গেলে তাঁর প্রতি সুবিচার হবে না। গীতিকবিতার সহজ স্ফূর্তি নেই তাঁর রচনায়।’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : অর্কেস্ট্রা, পৃষ্ঠা ৮২)
অন্যত্র বলেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কবিতা ও আমার উপভোগের মধ্যে কোথায় যেন একটা ব্যবধান দেখতে পেয়েছি। তাঁর কবিত্বশক্তিকে স্বীকার ও সম্মান না করা অসম্ভব; কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার মেজাজের মিল নেই।’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : ক্রন্দসী, পৃষ্ঠা ৮৪)
পরের প্রবন্ধেই তিনি আবার বলেছেন, ‘‘কালের পুতুলের’ কোনও কোনও আলোচনা যে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হয়নি এ-কথা সবচেয়ে বেশি জানি আমি, আর সে-দুঃখ সবেচেয়ে বেশি আমার। কিন্তু প্রতিকারের সময় আর নেই। বিষ্ণু দে আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্বন্ধে রচনা দুটি অর্ধ-মনস্ক হয়েছে, বইয়ের প্রুফ দেখতে দেখতে এ-চিন্তা আমার মনকে বার বার পীড়া দিয়েছে।” (পৃষ্ঠা ৮৮)
‘বিষ্ণু দে : ‘চোরাবালি’’ লেখাটি একটি চিঠির মতো। মনে হয় বুদ্ধদেব বসু কবিকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখেছেন। শুরুতেই বলা হয়েছে, বিষ্ণু দের সঙ্গে এবং তার লেখার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর পরিচয় দশ বছরের। এক পর্যায়ে তিনি বলছেন, ‘আপনার কবি প্রতিভায় আমি আস্থাবান; এ-দেশে কবিতা যাঁরা ভালোবাসেন, লেখেন ও লিখতে চেষ্টা করেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই আপনার রচনা খুব মনোযোগপূর্বক পড়া উচিত সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই; আর সেইজন্য যেখানেই আমার মনে হয়েছে আপনি যে স্বেচ্ছায় আপনার কবিতার আবেদন খর্ব করেছেন, সেখানেই আমার মন প্রতিবাদ করেছে।’ (পৃষ্ঠা ৯৬)
সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য : প্রথমত, তিনি বোধ হয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি, প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; কোনও অস্পষ্ট মধুর সৌরভ তাঁর রচনায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম কবিতাগুলোতে লক্ষণীয় ছিল। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্যরচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।’ (পৃষ্ঠা ৯৭)
জীবনানন্দ দাশ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো অমিয় চক্রবর্তীকে নিয়ে তিনটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে কালের পুতুলে। তিনি মনে করেন, ‘অমিয় চক্রবর্তীর মন পুরোপুরি আধুনিক ছাঁচে ঢালাই করা। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বহির্মুখী।’ তিনি আবার বলেছেন, ‘অমিয় চক্রবর্তীর আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে বাঙালি কবিদের মধ্যে তিনি প্রকৃতই সর্বদেশীয়। নতুন বিচিত্র ভূগোলের অভাবিত রস পরিবেশন করেছেন তিনি।’ তৃতীয় প্রবন্ধে অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে লেখকের অভিমত এমন—‘সমকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক কবি অমিয় চক্রবর্তী।’
নিশিকান্ত সম্পর্কে লেখক বলেছেন, ‘প্রথমেই বলে রাখি যে নিশিকান্ত’র কবিতার আমি অনুরক্ত। তাঁর ‘পণ্ডিচেরির ঈশান কোণের প্রান্তর’ (‘কবিতা’য় প্রকাশিত) বাংলা গদ্যকবিতার মধ্যে একটি প্রধান রচনা বলে আমি মনে করি।’ (পৃষ্ঠা ১২৫) প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু তার লেখায় অন্নদাশঙ্কর রায় সম্পর্কে বলেছেন, ‘শ্রীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর রায় ভবিষ্যতের কিংবা অদৃষ্টের ওপর ভরসা রাখেননি, তিনি প্রাক-চল্লিশেই নিজের কাব্যসংগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আধুনিক কবিদের মধ্যে এ ধরনের উদ্যম তাঁরই প্রথম।’ (পৃষ্ঠা ১২৯)
শেষের দিকে তিনি দু’জন তরুণ মৃত কবিকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তারা হলেন—ফাল্গুনী রায় ও সুকুমার সরকার। ফাল্গুনী রায়কে নিয়ে লেখা নাতিদীর্ঘ এ প্রবন্ধ মাত্র বারোটি কবিতা পড়ে তিনি লিখেছেন। তার ভাষায়, ‘এই বারোটির যে-কোনও একটি কবিতা পড়লেই বোঝা যাবে যে ফাল্গুনী যথার্থ বাকপ্রেমিক। তাতে প্রমাণ হয় যে তিনি জাত-কবি।’ (পৃষ্ঠা ১৩৬) হাঁড়ির একটি ভাত টিপলেই যেমন সব ভাতের অবস্থা বোঝা যায়; তেমনই তিনি মাত্র কয়েকটি কবিতা পড়েই ফাল্গুনীকে ‘জাত কবি’ আখ্যা দিলেন। অপরদিকে সুকুমার সরকার মাত্র পাঁচ-ছয় বছর কবিতা লিখেছিলেন। তাতেই শুধু সাময়িকপত্রেই তাঁর শতাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। হয়তো অপ্রকাশিত লেখা ছিল তারও বেশি।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য—‘বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরে সবেচেয়ে বড়ো কবিত্বশক্তি নজরুল ইসলামের। তিনি যখন সাহিত্যক্ষেত্রে এলেন তখন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্ঠিত, সে সময় তাঁর প্রভাব বোধহয় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৪) এ ছাড়া যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সম্পর্কে বলেছেন, ‘যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বাংলা কাব্যের সেই যুগের প্রতিভূ, যখন রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল থেকে মুক্ত হবার ইচ্ছেটা জেগে উঠেছে, কিন্তু অন্য পথ ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ (পৃষ্ঠা ১৪৭)
বইটির নামপ্রবন্ধে লেখক বলেন, ‘যাকে আমরা মতামত বলি সে-জিনিসটা অত্যন্ত অস্থির। তার উপর নির্ভর করতে ভয় হয়।’ (পৃষ্ঠা ১৪৯) অন্যত্র বলেন, ‘সমালোচনাকেই সাহিত্য করে তুলতে পারলে মস্ত একটা সুবিধে এই যে পরবর্তীযুগে মতামতগুলো সর্বাংশে গ্রাহ্য যদি না-ও হয়, সাহিত্যরসের প্রলোভনেই পাঠক সেখানে আকির্ষিত হবে, তার মধ্যে সত্য প্রচ্ছন্ন থেকে মনকে নাড়া দেবে সুন্দর, তাই কোনও কালেই তা ব্যর্থ হবে না।’ (পৃষ্ঠা ১৫১)
বুদ্ধদেব বসু ‘কালের পুতুল’ বইয়ে তার সমকালীন কয়েকজন বাঙালি কবির রচনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনায় তার উৎসাহ, অনুরাগ, শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন কবিতার সঙ্গে আছেন। তাই নিজেকে সার্থক বলে মনে করেন। তার এই সার্থকতাবোধ আসে মূলত মূল্যবোধ থেকে। বুদ্ধদেব বসুর সেই মূল্যবোধ আমাদেরও শিখিয়েছে সমালোচনা করার ধরন। বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে তার সমালোচনায়। উপকৃত হয়েছেন কবি-লেখক ও বোদ্ধারা।
সবশেষে বলতে হয়, বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য আলোচনায় বিশেষ কিছু ব্যাপার লক্ষণীয়। মাইকেলের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার যে বিস্তার ঘটেছে; ক্রমেই সেই আধুনিকতায় এসেছে নবতর পরিবর্তন। এতদিন ধরে নীতিবাদী সাহিত্যচর্চার ভেতরে থেকে বাংলা কবিতায় রোমান্টিকতার যে প্রাবল্য প্রবহমান ছিল। তিরিশের দশকে এসে ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা কবিতাও ভাবপ্রকরণে বদলে যেতে থাকে। বদলে যাওয়া কবিতার স্বরূপ সুচিহ্নিত করার প্রয়াসে বুদ্ধদেব বসু ভেবেছেন। এমনকি সেই কাব্যভাবনা প্রবন্ধ আকারে লিখে প্রচারের ব্যবস্থাও করেছেন। সেসব পড়ে মনে হবে যেন পাঠকেরই প্রতিক্রিয়া।
কবিদের অভিভাবক এই কবি ও সাহিত্য সমালোচক ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ জগতের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। আমি তার বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
সূত্র:
কালের পুতুল, বুদ্ধদেব বসু
বিশেষ রচনা, সাহিত্য সওগাত