ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ যত অভিযোগ
প্রান্তডেস্ক:আবারও আলোচনায় ড. ইউনূস। নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন দেশের ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির খোলা চিঠি সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ পায়। এর পরই প্রশ্ন ওঠে বিজ্ঞাপন প্রচারে ৮০ লাখ টাকার মতো যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা কোথা থেকে এসেছে!
এই সূত্রে নতুন করে সামনে আসে ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকমের দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. ইউনূস সামাজিক ব্যবসার নামে দেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কল্যাণকে মোটা অংকের লভ্যাংশ দিচ্ছে তাঁরই আরেক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকম। অভিযোগ রয়েছে, লাভের আরো অংশ নামে-বেনামে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা চলছে। কিন্তু এসব তথ্য গোপন করে গ্রামীণ টেলিকম লভ্যাংশ বণ্টন হয় না মর্মে বানোয়াট বার্ষিক রিটার্ন প্রদান করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি কোম্পানী আইনের-৩৯৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর শাস্তি হচ্ছে অনধিক পাঁচ বছর মেয়াদের কারাদণ্ডসহ আর্থিক জরিমানা।
জানা যায়, দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যয় হবে এবং কম্পানির সদস্যদের মধ্যে কোনোরূপ লভ্যাংশ শেয়ার না করার শর্তেই গ্রামীণ টেলিকমকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানী আইনের ২৮ (১) এবং ২৯ (১) ধারায় কোন সদস্যকে বা ব্যক্তিকে কম্পানির বণ্টনযোগ্য মুনাফা লাভের অধিকার প্রদান না করার জন্য সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। কিন্তু ড. ইউনূস প্রতিবছর গ্রামীণ টেলিকমের হাজার কোটি টাকার ওপর ডিভিডেন্ড সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে কয়েক হাত ঘুরিয়ে সামাজিক ব্যবসার নামে বিদেশে পাচার করে আত্মসাৎ করছেন।
১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের কাছ থেকে গ্রামীণ টেলিকম তথা গ্রামীণফোনের লাইসেন্স গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার আগে তিনি সরকারের কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই তিনি গ্রামীণফোনের লাইসেন্স নিতে চাচ্ছেন। অঙ্গীকার করেছিলেন, কোনো মুনাফার জন্য নয়, বরং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে সেবা প্রদানই হবে এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, তাদের স্বার্থের সুরক্ষার বদলে গ্রামীণফোনের অধিকাংশ শেয়ার বিদেশি কম্পানির হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন। অনেকেই মনে করেন, এর বিনিময়েই পরবর্তী সময়ে ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে নরওয়েজিয়ান কম্পানি টেলিনর।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোন লিমিটেডে তার ৩৪.২০% শেয়ারের বিপরীতে প্রতিবছর যে পরিমাণ লভ্যাংশ অর্জন করে, তার ৪২.৬৫% লভ্যাংশ গ্রামীণ কল্যাণ নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করে আসছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠার সময় গ্রামীণ কল্যাণের কাছ থেকে ৫৩ কোটি ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৯৪১ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছিল। আইন অনুযায়ী শুধু এই অর্থই গ্রামীণ কল্যাণকে ফেরত দেওয়ার কথা। জানা যায়, মাত্র ৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার বিপরীতে গ্রামীণ টেলিকম এ পর্যন্ত ৫০০০ কোটি টাকার ওপরে দিয়েছে গ্রামীণ কল্যাণকে বার্ষিক ৪২.৬৫% লভ্যাংশ হিসেবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কম্পানি আইনের ২৮ ধারায় গঠিত এই অলাভজনক কম্পানির কোনো শেয়ার মূলধন নেই, কোনো ব্যক্তি মালিকানা নেই। এর কোনো লভ্যাংশ অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তরেরও সুযোগ নেই। ফলে ড. ইউনূসের এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ সরানোর বিষয়টিকে কোম্পানী আইনের ২৮(১) এবং ২৯(১) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল এই দুই কম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিকেও তারা অবৈধ বলছেন। চুক্তিতে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকম প্রতিবছর তার লভ্যাংশের ৪২.৬৫ % গ্রামীন কল্যাণকে প্রদান করবে।
কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, কোম্পানী আইনের বিধান এবং লাইসেন্সের শর্তের পরিপন্থী ছিল ওই চুক্তি। এ ধরনের অবৈধ চুক্তির কোনো কার্যকারিতা নেই। তারা আরো বলছেন, ২০১১ সালের ওই চুক্তি সইয়ের এক দশকেরও বেশি সময় আগে থেকেই গ্রামীন টেলিকম বেআইনিভাবে গ্রামীণ কল্যাণকে লভ্যাংশ দিয়ে আসছিল।
জানা যায়, গ্রামীণ টেলিকমের নিরীক্ষকগণও বহু আগে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে এই সতর্ক করে যে গ্রামীণ কল্যাণকে প্রদানকৃত লভ্যাংশের বৈধতা নেই। এই অর্থ গ্রামীণ কল্যাণ কোথায় খরচ করেছে সেই তথ্যও পাওয়া যায় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রামীণ কল্যাণের এমন কোনো প্রকল্প নেই, যেখানে এই অর্থ ব্যয় হতে পারে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ৫০০০ কোটি টাকা এখন গ্রামীণ কল্যাণের হাতে নেই ।
সূত্র মতে, গ্রামীণ টেলিকমের বাকি লভ্যাংশ অর্থাৎ ৫৭.৩৫ % লভ্যাংশ, যার পরিমাণ ৭০০০ কোটি টাকার বেশি, সেই অর্থেরও হদিস নেই। মনে করা হয়, এর প্রায় ৯০ ভাগ নামে-বেনামে অবৈধভাবে হস্তান্তর কিংবা সামাজিক ব্যবসার নামে পাচার হয়েছে। পরে সেই অর্থ দিয়ে ড. ইউনূস নিজের ব্যক্তিগত নামে বিভিন্ন দেশে সম্পদ ক্রয়সহ নানা ব্যবসা করছেন।
জানা যায়, গ্রামীণ কল্যাণ ছাড়াও ড. ইউনূসের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা বেআইনিভাবে প্রদান করছে গ্রামীণ টেলিকম। ট্রাস্টের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলামের প্রস্তুতকৃত একটি হিসাব থেকে দেখা যায় ৩১ ডিসেম্বর, ২০১০ থেকে ২২ আগস্ট, ২০১৩ সময়ের মধ্যে গ্রামীণ টেলিকম শুধু গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টকে ১ হাজার ৪১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা দান হিসেবে দিয়েছে, যা পরে কয়েক হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এ অর্থও বেআইনিভাবে নানান হাতবদলের পর সামাজিক ব্যবসার নামে বিদেশে পাচার হয়েছে এবং বিদেশে এই অর্থের একমাত্র সুবিধাভোগী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম্পানি আইন এবং লাইসেন্স অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকম একটি অলাভজনক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও ড. ইউনূস বেআইনিভাবে গ্রামীণ টেলিকম থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন, যা কোকম্পানী আইনের ৩৯৭ ধারার লঙ্ঘন। গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্য এই অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না বলেও মনে করছেন বিষেজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিধান অনুযায়ী তারা সবাই পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধ করেছেন।
কোম্পানী আইনের ৩৯৭ ধারায় রয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের আওতায় আবশ্যকীয় বা এই আইনের কোনো বিধানের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রণীত কোনো রিটার্ন, প্রতিবেদন, সার্টিফিকেট, ব্যালান্সশিট, বিবরণী অথবা অন্য কোনো দলিলে কোনো গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে ইচ্ছাকৃত কোনো তথ্য, বিবরণ বা বিবৃতি দেন, যাহা সম্পর্কে তিনি জানিতেন যে উহা মিথ্যা, তাহা হইলে তিনি অনধিক পাঁচ বৎসর মেয়াদের কারাদণ্ডে এবং তৎসহ অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন, এবং উক্ত কারাদণ্ড যেকোনো প্রকারের হইতে পারে।’(সৌজন্যে:দৈনিক কালের কন্ঠ)