শালুক সাহিত্য পুরস্কার পেলেন তিন দেশের কথাসাহিত্যিক ও কবি
গতকাল সকালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম দিনের অধিবেশনে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।
প্রথমবারের আয়োজিত দ্বিবার্ষিক এই সাহিত্য সম্মেলনে কথাসাহিত্যে সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক ইমতিয়ার শামীম ও ভারতের কিন্নর রায়। অনুবাদে নেপালের সুমন পোখরেল, কবিতায় বাংলাদেশের কবি জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানে তাদের হাতে পুরস্কার সম্মাননা তুলে দেয়া হয়।
অধুনাবাদী চিন্তার ছোটপত্রিকা শালুক-এর ২৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে ঢাকায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে এই সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার, অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন, অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক ও নেপালের কবি-অনুবাদক সুমন পোখরেল। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে উদ্বোধনী নৃত্য পরিবেশিত হয়। পরে অতিথিরা মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলন করেন। শালুক সাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানে অতিথি ও পুরস্কারপ্রাপ্তরা
অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, ‘এ ধরনের সাহিত্য সম্মেলনের বড় দিক হলো, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষদের একসঙ্গে নিয়ে এসে পরস্পরকে জানার সুযোগ করে দেয়। পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের ভাষা, আবেগ, অনুভূতি বা সংস্কৃতির কথা কীভাবে তাদের সাহিত্যে চিত্রিত হয়, তা এই সম্মেলনে এসে জানতে পারেন অন্য প্রান্তের কবি বা লেখক।’
অনুবাদকর্মে আরও বেশি গুরুত্বারোপ করলে বিশ্বসাহিত্যের পাঠক আরও বেশি সমৃদ্ধ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থগুলোর অনুবাদ হওয়া এখন জরুরি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগের অধীনে অনুবাদ সেল গঠন করা যেতে পারে। একটা সময় দেখা যেত যে কেবল ইংরেজি থেকেই অনুবাদ হচ্ছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের বহু তরুণ লেখক বা অনুবাদক পৃথিবীর নানা ভাষা শিখে এসে মূল বইটি থেকেই অনুবাদ করছে। আমরা যেমন অন্য দেশের সাহিত্যের অনুবাদ করব, তেমনিভাবে আমাদের সাহিত্যেরও যথাযথ অনুবাদ হতে হবে।’
অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন তার বক্তব্যে সাহিত্যের ছোটকাগজের গুরুত্ব তুলে ধরেন। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটকাগজ ‘সবুজপত্র’ -এর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯১৪ সালের আগে বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অচলাতায়ন তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সেখানে ভাবনা-চিন্তা এবং বহু ভাষা থেকে তথ্য নিয়ে বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রকাশিত হয়েছিল ‘সবুজপত্র’। সেই সবুজপত্র ছিল প্রতিবাদমূলক কিংবা ভিন্ন পথে সাহিত্যকে প্রবাহিত করার জন্য। এর গুরুত্ব আরও বোঝা যায়, যখন এই সবুজপত্র ভাষাকে পাল্টে দিল, এমনকি রবীন্দ্রনাথকে পাল্টে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন ছোটগল্প ‘চতুরঙ্গ’; পরে লিখেছেন নতুন ভঙ্গির নাটক ‘ফাল্গুনী’।’
সাহিত্যের ছোটকাগজের মাহাত্ম্য বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দখল করার মানসিকতা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তার সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ এবং এটাই সর্বশেষ। সাহিত্যের এই বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোটদের উঠতে দেয় না। তখন তাদের প্রকাশ ও বিস্তৃতির জন্য লিটল ম্যাগাজিন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মানবকল্যাণের লক্ষ্যে মনোজাগতিক ভাবনায় তারা নতুন কিছু করতে চায়। যান্ত্রিক সভ্যতায় রোবোটিক জীবন থেকে মুক্তি দিতে তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অন্তর্জগতে নানা ভাবনার খোরাক জোগায়।’
নেপালি কবি-অনুবাদক সুমন পোখরেল বলেন, ‘আমাদের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো ছড়িয়ে রয়েছে এখানে-ওখানে, সেগুলো আবহমান কাল ধরে আমাদের পরিচয় বহন করছে। বিশ্বায়নের এ যুগে আমরা সমসাময়িক বিষয় নিয়েই লিখছি বেশি, কিন্তু পাশাপাশি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথাও তুলে আনতে হবে সাহিত্যে বা কবিতায়।’
আনোয়ারা সৈয়দ হক ঢাকায় সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের জন্য শালুক পরিবারকে ধন্যবাদ জানান।
উদ্বোধনী সেশনের পর কবি-কথাসাহিত্যিকরা ‘সীমানা পেরিয়ে আপন ভুবন’-বিদেশি লেখকদের কথা’, ‘বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ’, কবিতার শক্তি, কবিতায় মুক্তি’, ‘কথাসাহিত্যের দিক-দিগন্ত’, ‘কবিতা আজ ও অনন্তের’ শিরোনামে চারটি সেশনে আলোচনায় অংশ নেন।
আজ দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে। এদিন সকাল ১১টা থেকে শুরু হবে সাহিত্যের অধিবেশনগুলো। এই অধিবেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আদিবাসী সাহিত্য ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষা’, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন’, ‘কবিতা আজ ও অনন্তের’, ‘দক্ষিণ-এশিয়ার সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের অনুবাদ তত্ত্ব’।
রাতে শালুকের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে দু’দিনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ।