টিপু হত্যা: ‘জবানবন্দিতে নাম আসা আ’লীগের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছে ডিবি’
প্রান্তডেস্ক: মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কানেকশনই খুঁজে পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। মূলত ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ কয়েকটি কারণে বিদেশে ‘পলাতক’ থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জাফর আহম্মেদ মানিকের নির্দেশনায় টিপুকে হত্যার ছক বাস্তবায়ন করা হয়। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় করা মামলা তদন্তে প্রায় ১ বছর হয়ে গেলেও এমন তথ্যই পেয়েছে তদন্তকারীরা।
তবে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এ পরিকল্পনায় টিপু হত্যায় নানাভাবে ‘জড়িত’ বলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নামও উঠে এসেছে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী সুমন শিকদার মুসার জবাববন্দিতে। তবে তদন্তকারীরা বলছেন, জবানবন্দিতে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম আসলেও তাদের মধ্যে দুইজন শীর্ষ নেতার সংশ্লিষ্টতা এখনও তারা খুঁজে পায়নি। অন্য যাদের নাম এসেছে তারা গ্রেপ্তার হয়েছে আগেই।
এদিকে এ মামলার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানায়, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনাল টিম। টিমের এডিসি মো. শাহিদুজ্জামানের নেতৃত্বে মামলাটির তদন্ত করছেন ইনপেক্টর মো. ইয়াসিন শিকদার। এ হত্যা মামলায় তদন্তে করে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের অভিযুক্ত করে মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হচ্ছে। তবে চার্জশিটে গ্রেপ্তার আসামিদের বাইরেও আওয়ামী লীগের যেসব নেতাদের নাম এসেছে তাদেরও এ মামলায় আসামি করা হতে পারে বলে জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, টিপু হত্যা মামলাটি আগামী ১৬ এপ্রিল এ মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছে আদালত। গ্রেপ্তার আসামিদের জামিন শুনানিতে এদিন ধার্য করা হয়। মামলাটি এখন ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালতে রয়েছে।
ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, টিপু হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদার মুসার নাম আসার পর বিদেশ থেকে মুসাকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেয়া হয়। দুবাইতে গ্রেপ্তারের পর মুসাকে দেশেও ফিরিয়ে আনা হয়। এর আগে এ হত্যায় গ্রেপ্তার অন্যান্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে মুসাসহ হত্যায় কার কি ভূমিকা ছিল সেসব তথ্য পেয়ে যায় তদন্তকারীরা। হত্যায় সরাসরি জড়িত শুটার আকাশ ও নাছির আদালতে জবানবন্দি দেয়। সেখানে টিপু হত্যা কিভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে তার একটি পরিষ্কার চিত্র উঠে আসে। তবে মুসাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর রিমান্ড হেফাজতে মুসা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। কিন্তু আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে মুসা হত্যার বিষয়ে জানতেন দাবি করে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম বলে।
ডিবির তদন্তকারীরা বলছেন, মুসার জবানবন্দিতে যেসব আওয়ামী লীগ নেতার নাম এসেছে তাদের মধ্যে দুইজন আগেই গ্রেপ্তার করেছে। তবে অন্য দুইজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতার নাম এসেছে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ মুসার জবানবন্দিতে ওই নেতার ভূমিকার বিষয়ে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে মাঠ পর্যায়ের তদন্তে শীর্ষ ওই দুই নেতার সেরকম ভূমিকা থাকার কোন তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। হত্যায় জড়িত অন্য আসামির রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে এবং মুসা ছাড়া জবানবন্দি দেয়া আকাশ ও নাসিরের জবানবন্দিতে ওই দুই নেতার বিষয়েও কোন তথ্য নেই।
ডিবির পদস্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিপু হত্যায় দেশের বাইরে থাকা দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিকের সংশ্লিষ্টতার বাইরে হত্যাকা-ের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন করার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূল পরিকল্পনাকারী সুমান শিকদার মুসাকে গ্রেপ্তার করা এ মামলার তদন্তে সবচেয়ে বড় সফলতা। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ২৫ জনের নানাভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তবে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দক্ষিণের যে দুইজন শীর্ষ নেতার নাম এসেছে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো আরও পুঙ্খনুভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু আমরা এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তাই চার্জশিটে তাদের অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। পাশাপাশি যেহেতু একজন আসামির জবানবন্দিতে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুইজন শীর্ষ নেতার নাম এসেছে তাদেরকেও চার্জশিটে আসামি করা হবে। তাদের নাম বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। তাদের বিষয়ে কি হবে সেটি আদালতে শুনানিতে নির্ধারণ করবে আদালত।
গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান ওরফে প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। জাহিদুল হত্যার ঘটনায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী ফারহানা ইসলাম অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে শাহাজাহানপুর থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবির) খিলগাঁও জোনাল টিম। পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, টিপু হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ২৫ আসামি হলেন- সুমন শিকদার ওরফে মুসা, নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির, ওমর ফারুক, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্যা পলাশ, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, আবুল হোসেন মোহাম্মদ আরফান উল্লাহ, ইমাম খান ওরফে দামাল, নাসির উদ্দিন মানিক মারুফ খান, মশিউর রহমান একরাম, ইয়াসির আরাফাত সৈকত, সেকান্দার সিকদার আকাশ, হাফিজুল ইসলাম, ইশতিয়াক আহম্মেদ জিতু, ইমরান হোসেন জিতু, রাকিবুর রহমান, মাহবুবুর রহমান, জুবের আলম খান রবিন ওরফে রেলওয়ে রবিন, আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ‘ঘাতক’ সোহেল, খাইরুল ইসলাম, সোহেল শাহরিয়ার, মারুফ রেজা সাগর, শামীম হোসাইন ওরফে মোল্লা শামীম, তৌফিক হাসান ওরফে বাবু, সুমন হোসেন ওরফে সুমন, এহতেশাম উদ্দিন চৌধুরী ওরফে অপু ও শরিফুল ইসলাম ওরফে হৃদয়।
এদের মধ্যে মুসা, আকাশ ও নাসির হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে ইশতিয়াক আহম্মেদ জিতু, ইয়াসির আরাফাত সৈকত ও রাকিবুর রহমান এবং এছাড়া ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে মশিউর রহমান একরাম ও আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ঘাতক সোহেল জামিন পেয়েছেন।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ তার কার্যালয়ে সংবাদকে জানান, আমরা টিপু হত্যার তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছি। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে এখন পর্যন্ত যাদের নানাভাবে সংশ্লিষ্টতা ছিল সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে। তদন্তে খুটিনাটি কিছু বিষয় রয়েছে সেগুলো যাচাই-বাচাই করে শ্রীঘ্রই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিদ দেয়া হবে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তদন্তে যা পাওয়া গেছে সেগুলোর তথ্যপ্রমাণ আমরা মিলিয়ে দেখছি। যেহেতু মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ এবং হত্যাকা-টি বেশ চাঞ্চল্যকর তাই উড়ো তথ্যের ওপর নিভর না করে তথ্যপ্রমাণ মিলিয়ে চার্জশিট দিতে চাওয়ার কারণে কিছুটা সময় লাগছে। আশাকরি হত্যাকান্ডে কাদের কি ভূমিকা ছিল তা চার্জশিটে উঠে আসবে।
আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার নাম আসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র দাবি করে, এ হত্যাকান্ডে-র সুষ্ঠু তদন্ত ও হত্যাকান্ডে- জড়িতদের বিচার হোক তারাও সেটি চান। কিন্তু আসামিদের কারো কারো জবানবন্দির বরাত নিয়ে এ হত্যাকা-ে যে দুজন শীর্ষ নেতার নাম জড়ানো হচ্ছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশেমূলক। কতিপয় ব্যক্তি এ নিয়ে গোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছেন। আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছেন টিপু হত্যাকা-ের দিন টিপুর গাড়িতে দুজন ব্যক্তি তার সঙ্গে ছিলেন। এদের একজন আওয়ামী লীগের কর্মী বোচা বাবুর বাবা আরেকজন মিরাজ। তিনি টিপু হত্যার পরিকল্পনকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের মামা শ্বশুর। সুমন শিকদার মুছা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে টিপুর দ্বিতীয় স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলির পক্ষে ভাড়াটিয়া হিসেবে কাজ করেছে। ২০২০ সালের ওই নির্বাচনে ডলি ১, ১১ এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছিলেন। নির্বাচনে ডলিকে জয়ী করতে সুমন শিকদার মুসার একটি বড় ভূমিকা ছিল। মুছা তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নির্বাচনে ডলি ও আরেকজন পুরুষ কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় ছিল। নিয়মিত সেই সময় মুছা ডলি ও পুরুষ কাউন্সিলরের বাসায় যাতায়াত করতো। তখন এ সুবাধে টিপুর সঙ্গেও মুছার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর ২ বছর পরই সেই মুছা আবার টিপুকে হত্যায় পরিকল্পনাকারী হিসেবে বড় ভূমিকা রাখে। এ কারণে মুছার জবানবন্দিতে এ হত্যাকা-ের নেপথ্যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম আসায় বিষয়টি তারা ভিন্ন চোখে দেখছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী টিপুর স্ত্রী (কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগে সহ-সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর) ফারহানা ইসলাম ডলি সংবাদকে জানান, টিপু হত্যকা-ের পর মামলা করেছি। অনেক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে, বিদেশ থেকে হত্যার পরিকল্পনকারী সুমন শিকদার মুসাকেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে। হত্যাকা-ের ঘটনায় অনেক কথা বার্তা হয়েছে। বিদেশে থাকা দুইজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এসেছে, পরিকল্পনা বৈঠক হয়েছে। এগুলো কোন বিষয় নয়, এখন বিষয় হচ্ছে মুসার জবাববন্দিতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নাম এসেছে। আমি চাই তাদের গ্রেপ্তার করা হোক।