শহীদ তাজুল ইসলাম, সশ্রদ্ধ অভিবাদন
হাবীব ইমন : তাজুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুব সমাজের এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের দৃপ্ত পদচারণে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের বিকাশের সম্ভাবনাকে তিনি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে গেছেন। তাজুল ইসলাম শহীদ হয়েছিলেন ১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি; আদমজী পাটকলের বিশাল শ্রমিক অঙ্গনে। ওই পাটকলটিতে তখন এরশাদ শাহির অনুচর শ্রমিক নেতা একদল দাঙ্গাবাজ পাঠিয়ে মধ্যরাতের মিছিলে হামলা চালিয়ে মাথা থেঁতলে তাজুলকে হত্যা করেছিল। আজ তাঁর স্মৃতি প্রায় বিস্মৃত। আজকের যুবক প্রজন্ম তাঁকে খুব একটা জানে বলেও মনে হয় না। এই মহান শহীদকে আমরা যে আজকাল খুব বেশি মনে রাখি না, তার কারণ প্রধানত দুটি বড় বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত প্রধান ধারার যে রাজনীতি এখন চলছে, তাতে আত্মত্যাগের কোনো মূল্য গূঢ়ার্থে কানাকড়িও নেই। আছে কেবল ভোগসর্বস্বতা, নোংরামি, টাকার খেলা ও আর্থসামাজিক কর্মসূচিবর্জিত প্রদর্শনবাদ। তাজুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেও সেটাকে গোপন করে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কষ্টকর কায়িক শ্রমের কাজ করেছেন এবং এভাবে একজন শ্রমজীবীর মতোই আর্থিকভাবে কষ্টকর জীবনযাপন করেছেন। কেননা তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে ‘শ্রেণিচ্যুত’ করে শ্রমিকের সঙ্গে পরিপূর্ণরূপে মিশে গিয়ে তাদের বিপ্লবের জন্য সচেতন ও সংগঠিত করতে। তিনি একজন আদর্শবান কমিউনিস্টের ভূমিকা পালন করেছেন, যা আজকে সত্যিই বিরল। রাজনীতির এই কলুষিত যুগে তাজুল ইসলামকে ভুলে যাওয়া হবে, মিডিয়াতেও তাঁর প্রচার হবে না–এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এটাই শেষ কথা হতে পারে না। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের হাত থেকে, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করে সেই পূর্বাকার ধারায় প্রবাহিত করতে হবে। তাই বিপ্লবী তাজুল ইসলামের শহীদ দিবস উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সময়টা ১৯৮৪ সাল। সেই বছর ছিল লিপইয়ার। সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাস ছিল ২৯ দিনে। ওইদিনেই স্বৈরশাসকের ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন তাজুল ইসলাম। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ১ মার্চ নিহত হন। ১ মার্চ-কেই ‘তাজুল দিবস’ হিসেবে পালন করেন তার সহযোদ্ধাবৃন্দ। সাধারণ দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাজুলের জন্ম, চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। বেশ কষ্টের মধ্যে তাঁকে লেখাপড়া করতে হয়েছিল। তবে তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে বরাবর প্রথম স্থান অধিকার করতেন। বৃত্তির টাকা দিয়ে তাঁর লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছিল। কৈশোরের একটা সময় তাঁর কেটেছিল আইসক্রিম বিক্রি করে। শিশুশ্রমের কঠিনকে বরণ করেছিলেন সহজেই। মামার অভিভাবকত্বে তিনি শিক্ষাগ্রহণে ব্রতী হন। তিনি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কুমিল্লায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৬৬ সালে মতলব হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ৩টি লেটারসহ এবং পরবর্তীকালে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯৬৮ সালে তাজুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে বিএ অনার্সে ভর্তি হন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন ও বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনসহ গণসংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি স্কুলের হকি টিমের অধিনায়কও ছিলেন। ভালো গানও গাইতেন তিনি। উচ্চাঙ্গসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত। ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। এ সময়ই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের’ যৌথ উদ্যোগে ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষাজীবন শেষ করে তাজুল ইসলাম যোগ দিয়েছিলেন আদমজীর শ্রমিক হিসেবে। হতে পারতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক কিংবা বিরাট অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার-অনেক কিছুই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে তিনি দুঃখকষ্টের জীবনের অবসান ঘটাতে পারতেন। মেধাবী ছাত্রের জন্য বড় চাকরি, বড় সামাজিক মর্যাদা, বিত্তবৈভব অর্জন করা কঠিন ছিল না। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে সাধারণ বদলি শ্রমিকের চাকরি নিলেন আদমজীতে। তাঁত চালাতেন। থাকতেন বস্তিতে। সামান্য পয়সায় দুই সন্তান নিয়ে সস্ত্রীক থাকতেন। তাও আবার এক দিন-দুই দিন নয়, দু-এক বছরও নয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক দশক এভাবে সাধারণ বদলি শ্রমিকের কাজ করেছেন ও জীবন কাটিয়েছেন। ১৯৭৫ এরপর জলপাই রঙের পোশাক আর কালো বুটের পদপৃষ্টে বাংলাদেশ। কালের চাকাকে উল্টে দিয়ে বিশ্বাসঘাতক মোশতাক চক্র জেনারেল জিয়ার সহায়তায় ক্ষমতা দখল করে। পৌনঃপুনিক সামরিক শাসনের জাঁতাকলে আটকে যায় বাংলাদেশ। বিপন্ন হয় আমাদের স্বাধীনতার চেতনা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ। সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় নানাবিধ ষড়যন্ত্র, হত্যা, ক্যুর মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন ও নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। সেই দিন থেকেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাঙালি সামরিক শাসন মানে না। ১৯৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অপ্রতিরোধ্য ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হন দীপালি সাহা, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, আইয়ুবসহ অসংখ্য সহযোদ্ধা। পিচঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয় সামরিক জান্তার বুলেট ও বেয়নেটে। এরশাদ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে উপজেলা পরিষদের কাঠামো তৈরি করে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ততদিনে দেশের রাজনীতির হাল ধরেছেন দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক নেতারা। তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ১৫ দলীয় রাজনৈতিক জোট, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) ও অন্যান্য পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। উপজেলা নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে ১৫ দলীয় রাজনৈতিক জোট হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করে। হরতাল সফল করার নিমিত্তে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি গ্রহণ করে। স্কপ শিল্প-কলকারখানায় ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট আহ্বান করে। স্কপের ধর্মঘটের সমর্থনে দেশের কল-কারখানা, শিল্পাঞ্চলে প্রস্তুতি চলছিল। দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজীতে ধর্মঘট প্রস্তুতির মিছিলে হামলা চালিয়ে খুনি এরশাদের মদদপুষ্ট ছায়াদুল্লাহ সাদুর গুণ্ডাবাহিনী ছুরিকাহত ও মাথা থেতলে দেয় শ্রমিক নেতা বীর কমরেড তাজুল ইসলামকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১ মার্চ হরতাল চলাকালে কমরেড তাজুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিপ্লবীর যেমন মৃত্যু নেই, তেমনি তাজুল ইসলামেরও মৃত্যু নেই। এখন প্রয়োজন মৃত্যুহীন তাজুলের অসামান্য জীবন আদর্শকে আগামী যুব প্রজন্মের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। আজকের দূষিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক ধারাকে পরিবর্তন করে সুস্থ প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রয়োজন হবে অসংখ্য তাজুল ইসলামকে। যুব সমাজ এমন একজন মানুষকে আবার কবে পাবে জানি না। কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পার্টিকে সত্যিকারের প্রলেতারীয় বিপ্লবীধারায় গড়ে তুলতে হলেও আমাদের প্রয়োজন কমরেড তাজুলকে। তাজুল যেভাবে শ্রমিকশ্রেণির গভীরে লীন হয়ে মানবমুক্তির সাধনা করেছেন, তা অতুলনীয়। শহীদ তাজুল ইসলাম, সশ্রদ্ধ অভিবাদন! লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর (সৌজন্যে:সাপ্তাহিক একতা)