হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ জরুরি
সৌমিত্র দস্তিদার:দিল্লির মতো পুলিশের ওপর ক্ষোভ গুজরাটেও কম শুনিনি। যেখানেই গেছি সেখানেই সংখ্যালঘু জনগণ অসহায় ভঙ্গিতে অভিযোগ করেছেন যে আমরা একেবারে ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম। একদিকে পুলিশ অন্যদিকে উন্মত্ত জনতা। বলা-কওয়া নেই, জিপ থেকে নামা মাত্রই পুলিশ চেঁচাচ্ছেনভাগো, ভাগো, ভাগো।’ যেন হিংস্র জনতার হাত থেকে নিরীহ জনতাকে বাঁচানোর কোনো দায় তাদের নেই। আমরা যে যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থাতেই দৌড়াচ্ছি। মহল্লার একটা পথ আটকে রেখেছে পুলিশ, উল্টো পথে ছুটতে ছুটতে দেখি অলিগলি সব বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে সংঘ পরিবারের মাস্তানরা। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো নারোদা পাতিয়া, কালুপুরা, জুহুপুরা, গুলবর্গা সোসাইটি সব জায়গায় এক কৌশলে হত্যালীলা চালিয়ে গেছে আর এস এস, বজরংদল ও আরও কিছু নব্য হিন্দুত্ববাদীরা।
তাই আজ যখন পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালনের অভিযোগ উঠেছে তখন একবারের জন্যও অবাক হইনি। গুজরাটের রাস্তায় রাস্তায় সেদিনের স্লোগান, দেয়ালের লেখা ‘ইয়ে গরব কি বাত হায় পুলিশ হামারা সাথ হায়।’ সোজা বাংলায় ‘এটা খুবই গর্ব ও আনন্দের বিষয় যে পুলিশ আমাদের সঙ্গে আছে।’ পুরনো বহুচর্চিত স্লোগান ফের ফিরে এসেছে দিল্লির মাটিতে। গুজরাটের প্রবীণ গান্ধীবাদী এস এম পাঠক এক দীর্ঘ ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে পুলিশ রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। খাকি উর্দি গায়ে সংঘী স্বেচ্ছাসেবীরাই পুলিশের জায়গা নিয়ে নির্বিচারে তান্ডব চালিয়ে গেছে।
গুজরাটে না গেলে কোনোদিনই জানতাম না যে বর্ডার বা সীমান্ত কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় থাকে না। একটা শহরের মধ্যে থাকে অজস্র মহল্লা। যা চলতি কথায় লোকজন বর্ডার বলে। একদিকে মুসলিম মহল্লা। অন্যদিকে হিন্দু এলাকা। মাঝখানে নো ম্যানস ল্যান্ড। কোনো মুসলিম নো ম্যানস ল্যান্ড পেরিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাড়ায় ঢুকলেই বলা হয় অমুক বর্ডার পার হয়ে এসেছে।
অনেক পরে যখন ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে ছবি করতে যাই, তখন সম্ভবত অবচেতন মনেই এ বর্ডার বিষয়টি মনের মধ্যে এমনভাবে থেকে গিয়েছিল যে তখন ছবির নাম ঠিক করেছিলাম সীমান্ত আখ্যান। অনেকেই এ নামের সমালোচনা করেছিলেন। আসলে তারা আশা করেছিলেন যে সীমান্ত বলতে আমি শুধু চেনাজানা সীমান্তই বলব। যার একদিকে ভারত বা ইন্ডিয়া, অন্যদিকে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। দুপাড়ে বন্দুক উঁচিয়ে দুদেশের ‘শান্তি রক্ষকরা’ শান্তি বজায় রাখতে সতত সক্রিয়। তখনো যা বলেছিলাম সীমান্ত আখ্যান নামের ব্যাখ্যায় এখনো তাই বলব। সীমান্ত কোনো নির্দিষ্ট ভূগোল নয়। সীমান্ত মানুষের মনে। মন থেকে যদি এ কল্পিত বর্ডার দূর না করতে পারি, তাহলে বছরের পর বছর এ বিভাজনের রাজনীতি চলতেই থাকবে।
পুলিশ প্রশাসন বিচার ব্যবস্থার একটা অংশ ও গণমাধ্যম নিয়েও আমাদের প্রত্যাশার পারদ থাকে অনেক উঁচুতে। আমরা ধরে নিই যে তারা সবাই ঠিক সময়ে ঠিক দায়িত্ব পালন করবে। ভাবটা এমন যেন সত্যিই আমরা এক প্লেটো কথিত চমৎকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাস করি। ব্যবস্থাটাই যেখানে পচে গেছে সেখানে কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক শাসন নিতান্তই কষ্ট কল্পনা। বিজেপি যে হিন্দু রাষ্ট্র করতে চায় তা ১৯২৫ সালে আর এস এসের জন্ম সময় থেকেই পরিষ্কার করে বলা আছে। একদা জনসংঘ, আজকের বিজেপি তো আর এস এসের রাজনৈতিক সংগঠনমাত্র। বিজেপি আজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার বহুদিনের পুরনো এজেন্ডা বাস্তবের চেহারা দিতে। তাই একতরফা বিজেপিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি আপনি বিভিন্ন বিরোধী দলগুলো, তথাকথিত শিক্ষিত উদারমনা ধর্ম নিরপেক্ষ দল, শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী কেউই আজকের ভয়ংকর অবস্থার দায় অস্বীকার করতে পারি না। তিন-চার দিন হয়ে গেল অথচ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই দাঙ্গা থামাতে।
এটা ঠিক যে, পুলিশ দপ্তর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর নিয়ন্ত্রণে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার মূল দায়িত্ব অবশ্যই তার দপ্তরের। তবু মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আম আদমি পার্টি বা আপ যে দাপট দেখিয়ে ভোটে জিতেছিল তাতে ভাবাই যায় যে আপের বিপুল কর্মী বাহিনী বিপন্ন মানুষের পাশে থাকবে। বিবৃতি দেওয়া আর তিন দিন বাদ উপদ্রুত এলাকায় মুখ দেখানো ছাড়া আর কিছুই কেজরিওয়াল করেছেন বলে কেউ শোনেনি। কংগ্রেস প্রথম দুদিন চুপ। ওই বিবৃতি দিয়ে বিজেপির দায়সারা সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর যিনি সবচেয়ে বেশি মোদিবিরোধী মুখ বলে শুধু বাংলা বা ভারতে নয়, সারা পৃথিবীতে পরিচিত তিনিও শুধু দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এক দেশের শান্তি বজায় রাখতে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিলেন ও দুই, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করলেন।
বামপন্থিরা মিছিল মিটিং করে শান্তি রাখতে সক্রিয় হয়েছেন এটা ঠিক। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, চিরকাল দেখে আসছি আক্রান্ত মানুষের পাশে থাকতে তারা বেছে নেন উপদ্রুত এলাকা। একদিকে এটা ইতিবাচক আক্রান্ত মানুষ অনেক মানুষকে একসঙ্গে দেখে ভরসা পান। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পাশাপাশি দক্ষিণপন্থি রাজনীতির যে ন্যারেটিভ বা তত্ত্ব তাকে খ-ন করতে বামেদের যে পাল্টা ন্যারেটিভ দরকার তা নিয়ে কোনোদিনই তারা মাথা ঘামাননি। এখনো মিছিল মিটিংয়ের অভিমুখ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দিকে হলে যেটুকু কাজ হতো, অন্তত আর এস এসের একতরফা মুসলিমবিদ্বেষী প্রচার কিছুটা হলেও আটকানো যেত সেই কাজটি বামপন্থিরা যথাযথভাবে করলেন না। করলে এ বিপুল শূন্য পরিসর তৈরি হতে পারত না। যেভাবে এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নিজেদের মাটি এমন শক্তপোক্ত করে তুলেছে তাকে প্রতিহত না করতে পারলে একের পর এক দাঙ্গা হবে। আর আমরা মিডিয়ার সামনে কুমিরের কান্না কাঁদতে কাঁদতে শান্তি রাখার ডাক দিয়ে যাব।
লেখক : ভারতের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ( সৌজন্যে: দেশরূপান্তর)