প্রভাতফেরির গান প্রথম গাওয়া হয়েছিল যে অনুষ্ঠানে
ইনাম আহমদ চৌধুরী: ১৯৫২ সাল। মনে পড়ে, আমরা তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। সরকারি কার্যব্যাপদেশে বাবার উপর্যুপরি কর্মস্থলের পরিবর্তনের কল্যাণে দুবছর দুই স্কুলে পড়তে হলো, স্কুলজীবনের শেষ প্রান্তে এসে। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ আর ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আবার চলে যেতে হলো বরিশাল। নতুন জায়গা বলে পরিচিতির সংখ্যা ছিল খুব সীমিত। গণযোগাযোগের মাধ্যমও তো এখনকার মতো এত ব্যাপক ছিল না। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সেদিন সংক্ষিপ্ত খবর পেলাম আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর গুলি হয়েছে। পরের দিন পেলাম বিস্তারিত খবর। ভাষার দাবিতে রক্ত ঝরেছে রমনার সবুজে। ছাত্রদের রক্তে রক্তাক্ত হয়েছে ঢাকার রাজপথ, দাবি আদায়ে দেশে এই-ই প্রথম আত্মাহুতি। দাবানলের মতো এ খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। প্রতিবাদী বিক্ষোভের অগ্ন্যুৎপাত হলো প্রদেশের সব শহরে, জনপদে ও শিক্ষায়তনে। পরীক্ষার সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি ছেড়ে বেরিয়ে এসে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালাম। জটলা, মাঝেমধ্যে সেøাগান, ছাত্রদের। পথচারী জনতার। স্তম্ভিত, বিক্ষুব্ধ, শোকাহত। ক্ষীণদেহী দু-একটা পত্রিকা হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাবলে অবাক লাগে কি করে সারাটি পরিবেশ জুড়ে বিদ্রোহী বেদনার এক অনুচ্চারিত অনুরণন সবাইকে আচ্ছাদিত করে তুলেছিল। কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। মাতৃভাষার বন্ধনের কি গভীর সম্মোহনী আকর্ষণ।ম্যাট্রিকের রেজাল্ট বেরোল। ভালো করলাম। ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে। কয়েক মাসের মধ্যেই কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ নির্বাচনে জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হলাম। আর জড়িয়ে পড়লাম ছাত্ররাজনীতির কর্মকাণ্ডে। তবে তখনকার আর এখনকার ছাত্ররাজনীতির মধ্যে গুণগত ও চরিত্রগত বহু পার্থক্য। কয়েক মাস পরে ফেব্রুয়ারির সূচনা থেকেই শুরু হলো প্রথম শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি। ছাত্র সংসদ থেকে আমরা গোপনে স্থির করলাম সিদ্দিকবাজারে কলেজের চত্বরে শহীদ মিনার তৈরি করা হবে, একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে। কিছুদিন পরেই করব বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যার মুখ্য উপজীব্য হবে ভাষা-সংগ্রাম।তখন ইডেন কলেজের ছাত্রীরা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে আসতেন ঢাকা কলেজে বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করার জন্য। কলেজ কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্য বাধা পরিহার করার জন্য স্থির করলাম মেয়েদের সহায়তা নিয়েই এই শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করা হবে। গোপনে ইট-সুরকি-সিমেন্ট সংগ্রহ করে রাখা ছিল। স্থানীয় কয়েকজনের সহায়তায়, বিশেষ করে এলাকার সমাজপতি মতি সরদার সাহেবের আনুকূল্যে। সকালবেলা ছাত্রীরা আসতেই অনুরোধ জানালাম শহীদ মিনার স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নিতে। তারা সোৎসাহে রাজি হলেন। ছাত্ররা ইট-সুরকি এগিয়ে দিলেন। আর মেয়েরা প্রতিস্থাপন শুরু করলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দারোয়ান বেয়ারারা বাধা দিতে এলো। কিন্তু মেয়েদের রুখবে কী করে? ঘণ্টা-দুয়ের ভেতরে বেশ সুন্দর একটি শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে গেল। ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মিনারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়ল। সম্ভবত সারা দেশে কোনো সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে এটাই ছিল প্রথম প্রতিষ্ঠিত শহীদ মিনার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্রিন্সিপাল সাহেব নেতৃস্থানীয় আমাদের দু-তিনজনকে ডেকে পাঠালেন। ইতিমধ্যে ইডেন কলেজের প্রিন্সিপাল মহোদয়া এসে ছাত্রীদের নিয়ে গেছেন। আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক শামসুজ্জামান চৌধুরী। সজ্জন, উদারমনা; কিন্তু ওই আমলের নিয়মতান্ত্রিক কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা। তিনি একটি লিখিত নির্দেশনামা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, সরকারি কলেজ চত্বরে অননুমোদিত নির্মাণ করে তোমরা কলেজের শৃঙ্খলাবিরোধী বেআইনি কাজ করেছো। এই স্তম্ভ তোমরা নিজেরা সরিয়ে না নিলে সরকারি আইন প্রয়োগকারীরা এসে ভেঙে দেবেন। আমরা বললাম, স্তম্ভটি শহীদ স্মৃতি-স্মারক। আইনের সঙ্গে এর কোনো বিরোধ নেই। তা ছাড়া কলেজের কোনো কাজে এই স্তম্ভটি কোনো বিঘœ ঘটাচ্ছে না। সুতরাং এটাকে সরিয়ে নেওয়ার বা ভেঙে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, সরকারি নির্দেশে তাহলে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার কোনো গত্যন্তর নেই। পরে তিনি আমাকে একা ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘দেখো, তুমি ভালো ছাত্র। তোমার চেষ্টা করা উচিত আইয়ে ফার্স্ট হতে। এসব বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়লে পুলিশ কেইস হবে। কলেজ থেকেও তোমাদের কয়েকজনকে এক্সপেল বা রাষ্টিকেট করতে হবে। সরকারের বিরাগভাজন হলে ভবিষ্যতে চাকরি-বাকরি বা স্কলারশিপ পেতে অসুবিধে হবে। তা ছাড়া, তোমার নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউনের একটি ইয়ুথ-প্রোগ্রামে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনাধীন আছে। ওসব আর হবে না। তুমি একটি গোপনীয় লিখিত বিবৃতি দাও এই মর্মে যে, এই নির্মাণের সঙ্গে কলেজ ছাত্র সংসদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি বললাম, এটা তো হতে পারে না। ছাত্র সংসদের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না হলেও আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটা করেছি। এটার দায়-দায়িত্ব আমরা অস্বীকার করি কী করে? আমাদের সিদ্ধান্ত ও মনোবল অটল। দলমত-নির্বিশেষে সবাই একাত্ম, এককণ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ঐক্যের এক সুদৃঢ় বন্ধনে আমরা গ্রথিত ছিলাম। আমাদের বক্তব্য ছিল শহীদ মিনার এখন আর শুধু স্মৃতি-স্মারক নয়, এই স্তম্ভ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার মহান সংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থন ও আনুগত্যের দৃপ্ত অঙ্গীকার।খবরটি ঢাকার এমনকি দেশের ও ছাত্রমহলে রটে গেল বেশ জোরেশোরে। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-নেতারাও আমাদের অভিনন্দন জানালেন, যোগাযোগ স্থাপিত হলো কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে। ৫৩ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন (পরে মুখ্যমন্ত্রী) মরহুম আতাউর রহমান খান, আওয়ামী লীগ নেতা। ২২ সোয়ারীঘাটে তার কার্যালয় ছিল। কর্মপরিষদের কোনো কোনো সভায় আমন্ত্রণ পেয়ে যোগদান করেছি। এ পর্যায়ের কেন্দ্রীয় নেতাদের সংস্পর্শে এসে আমরা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত বোধ করেছিলাম। মতিন ভাইয়ের (ভাষা মতিন) সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং তার সস্নেহ সমর্থন আমরা পাই। তার সঙ্গে আমৃত্যু যোগাযোগ ছিল।শহীদ মিনার নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন এসে গেল। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমাকে একটি প্রধান ও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হলো। গুলিস্তানের কাছাকাছি তখন ব্রিটানিয়া নামের একটি সিনেমা হলে (বহুযুগ হলো ওটা নেই)। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন হলো। ২ এপ্রিল ১৯৫৩। আমাদের উদ্যোগ আয়োজন দেখে প্রিন্সিপাল সাহেব ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘তোমাদের এই শহীদ মিনার নিয়ে গভর্নমেন্টকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছি। অ্যাকশন নিতে আর দেরি করতে পারছি না। তবে আমার একটি চিন্তা এসেছে। শিক্ষাসচিব এস এম ফজলী একজন শিক্ষা ও সংস্কৃতানুরাগী সংগীতপ্রেমী লোক। (ফজলী ব্রাদার্সের নিবিড় সম্পর্ক ছিল উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে)। তিনি একজন সিনিয়র আইসিএস/সিএসপি অফিসার। তাকে ও তার সঙ্গে ডিপিআই এবং স্বরাষ্ট্র বিভাগের দু-একজন কর্মকর্তাকেও দাওয়াত করতে চাই। আশা করি তাদের উপস্থিতির উপযোগী একটি অনুষ্ঠান তোমরা করতে পারবে। প্রধান অতিথি ফজলী সাহেবের ভালো লাগলে তার মাধ্যমে এই শহীদ মিনার নির্মাণঘটিত সমস্যাকে সমাধানের পক্ষে নিয়ে যাব।’ আমরাও বললাম আমরা একটি উঁচুমানের অনুষ্ঠান পরিবেশন করব। তখন অবশ্য ধারণা ছিল না, অনুষ্ঠানের রূপ ও চরিত্র কী হয়ে দাঁড়াবে এবং তার ফলাফল কীভাবে সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী হয়ে যাবে।অনুষ্ঠানের সূচির প্রথম পৃষ্ঠায়ই ছিল মায়াকভস্কির কবিতা থেকে একটি উদ্ধৃতি। অনুষ্ঠানের প্রত্যেকটি পরিবেশনা, নৃত্য, গান আর গীতিনাট্য ছিল প্রগতিবাদী ও গণস্বার্থনিষ্ঠ। গীতি-বিচিত্রা ‘আমার দেশ’ মুখ্যত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শহীদ স্মৃতি-তর্পণকেন্দ্রিক ছিল, সেটা মূলত সতীর্থ বন্ধুবর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রচনা। ছিল নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট। আবদুল লতিফ গাইলেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা/কাইড়া নিতে চায়।’ ছিল আবু জাফর ওয়ায়দুল্লাহ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা। ‘কিষানের কাহিনী’ ধূমকেতুর পরিচালনায় এই নৃত্যনাট্যে ছিল দেশের বঞ্চিত কৃষক-শ্রেণির স্বার্থ এবং অধিকার রক্ষার সংগ্রামের আহ্বান। বন্ধুবর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রচিত, ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’ একুশের প্রভাতফেরির এই অমর গানটি অনুষ্ঠানের দশম ক্রমিকে আলতাফ মাহমুদ কর্তৃক জনসমক্ষে প্রথম গীত হয়।
লেখক
সাবেক সচিব, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য