সমাজতন্ত্রী জুজুর ভয় দেখিয়ে জয়ের চেষ্টা
আমাদের একটি দৈনিকে ছোট একটি এক কলামের খবর, হয়তো অনেকের চোখ এড়িয়ে যাবে, কিন্তু খবরটি আন্তর্জাতিক বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিরোনাম : ‘সমাজতন্ত্রকে আমেরিকা ধ্বংস করতে দেব না’। (দেশ রূপান্তর, ৬ ফেব্রুয়ারি) এই দম্ভোক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ বক্তব্য স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে প্রদত্ত। এ জাতীয় ঘটনা মার্কিন প্রেসিডেন্সিতে নতুন কিছু নয়। এর ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিনের। ১৯৪৮ সালে দুই জার্মান রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনীষীর লেখা চটি একটি বইয়ের বৈশবিক আহ্বান পুরো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিশ্ব উপনিবেশের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সূচিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জার-স্ম্রাজ্যশক্তির পতন ঘটিয়ে গঠিত বিশ্বের প্রথম সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রকে নিয়েও দেখা দেয় ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একই আতঙ্ক।স
সেই থেকে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের জিহাদ রাষ্ট্রিক চরিত্র অর্জন করে। রুশ সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সংগঠিত করে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে নতুন সমাজব্যবস্থা তছনছ করার চেষ্টা চলেছে দীর্ঘসময় ধরে। অনেক প্রতিকূলতার তুফানের বিরুদ্ধে লড়াই করে তখনকার মতো টিকে গিয়েছিল নবগঠিত সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রটি, যদিও পরবর্তী সাত দশকে শেষ রক্ষা হয়নি মীরজাফরি বুর্জোয়া আমলাতন্ত্রের টানে। কিন্তু ওই যে সমাজতন্ত্র নামক এক জুজুর ভয় দেখিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো গণতন্ত্র রক্ষার স্লোগান তুলেছিল, তার সর্বোচ্চ প্রকাশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ শাসনতান্ত্রিক আসন থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে, সাধারণ বিচারে জনগণের মধ্যে সে আতঙ্ক বিরাজ করেছে নির্বিবাদে। শাসনতন্ত্র তা নানা অজুহাতে ছড়িয়ে দিয়েছে মার্কিনি জনগণের মধ্যে।
এমনই কুশলী ও কৌশলী প্রচার তথা অপপ্রচার, নানা ভাষ্যে যে তারা সে গল্পকাহিনী বিশ্বাস করেছে এবং শাসকদের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে। বোম্বেটে ইংরেজ অভিবাসী অধ্যুষিত উত্তর আমেরিকার কৃষি থেকে শিল্পে ও বিজ্ঞানপ্রযুক্তির উন্নয়নে সংগঠিত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে একদিকে দাসপ্রথার নির্মম শোষণ, অন্যদিকে স্থানীয় আদিবাসীদের নির্মূল করার অভিশপ্ত ইতিহাস। এভাবে পুরো একটি মহাদেশের দখলদারি। স্বভাবতই তার ধনগৌরব, শিল্প ও প্রযুক্তি গৌরবের টানে ইউরোপীয় মেধা ও মনীষার ব্যাপক আগমন, পরে অন্য দেশে থেকে, গঠিত হয় একটি বহুবর্ণ, বহু জাতিসত্তার মহাদেশীয় রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমন এক বহুবর্ণিল বহুত্ববাদের মধ্যেও সুস্থ মানবিক শাসনব্যবস্থা, শুদ্ধ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে তার বিদেশনীতির আগ্রাসনের কারণে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও অভ্যন্তরীণ কিছু সামাজিক সুযোগ-সুবিধা সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রতিবাদহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলেছে। সঙ্গে সমাজতন্ত্রী জুজুর আতঙ্কের আফিম। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বিশ্ব শাসন সহজ হয়েছে। ক্বচিৎ জনপ্রতিবাদ। যেম ভিয়েতনামে মার্কিন সেনা-বর্বরতার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ। আর সর্বশেষ তরুণদের-যুবকদের স্লোগান : ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ ধনাগার দখল করো। যোগ্য, দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে যা বানচাল হয়ে গেল।
দুই.
তাই ঈশপের গল্পের বাঘ ও মেষশাবকের কাহিনীর মতোই অজুহাত তুলে মার্কিনবিরোধী সাদ্দামের ইরাক দখলে বুশ-ব্লেয়ারদের যৌথ অভিযান জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে। অজুহাতটা ছিল জনবিধ্বংসী অস্ত্র আছে সাদ্দামের হাতে। এ ব্যাপারে ব্রিটেনের শ্রমিকদলীয় প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের চতুর পরামর্শ ছিল তুলনাহীন। শ্রমিক দল আর রক্ষণশীল টোরি দ ফারাকটা কোথায়? ধ্বংসযজ্ঞ শেষে, সাদ্দাম হত্যার পর কোনো অস্ত্র পাওয়া গেল না। কিন্তু ধ্বংস হলো, লুট হলো ঐতিহাসিক বাগদাদ নগরীর সম্পদ ও তার মিউজিয়াম।
তিন.
এদের চেয়েও এক কাঠি সরেস নাৎসিখ্যাত জার্মান বংশোদ্ভূত অভিবাসী মার্কিনি নাগরিক, প্রগাঢ় স্বৈরাচারী, বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে বিচিত্র পন্থায় নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট, নিজ দলেও তিনি বিতর্কিত নির্বাচনকালে। সাদাবাড়ির সিংহাসনে বসেই যিনি পূর্ববর্তী উদারপন্থি, কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের উদারনৈতিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প বাতিল করেন। একের পর এক তার উদ্ভট ঘোষণা মেক্সিকোকে বিচ্ছিন্ন করতে, অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে দেয়াল তুলবেন। তার উন্মাদ সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়ে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার পক্ষে তাৎক্ষণিক জোরালো সমর্থন সব ভিন্নমত অগ্রাহ্য করে। প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকের হাত শক্ত করতে তার অন্ধ সমর্থন তুলনাহীন
তার একের পর এক অসাংবিধানিক, অমানবিক, জনস্বার্থবিরোধী স্বৈরশাসনের ভূমিকা, যা অপশাসন হিসেবে চিহ্নিত। তার সর্বশেষ অপকীর্তি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট করা, শাসনযন্ত্রকে না জানিয়ে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে কবর দিয়ে একক গোপন সিদ্ধান্তে ইরানের শক্তিমান সামরিক নেতা কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সহায়তা নিয়ে, ড্রোন হামলায়। মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধের পরিবেশে ঠেলে দিয়ে। এ হত্যার বিচার হয়নি। তার উন্মাদ প্রলাপ নিয়ে অনেক গল্প, অনেক ঘটনা। স্বভাবত অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার ও অপশাসনের দায়ে অভিশংসনের মুখে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নিম্নকক্ষে তার অভিশংসন তথা ইমপিচমেন্টের পক্ষে সিদ্ধান্ত। তখন থেকেই তার মার্কিনি জাত্যভিমানী, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী প্রলাপ আরও জোর গলায় প্রচার শুরু। লক্ষ্য একটাই, সিনেটে অভিশংসন এড়ানো। স্বভাবতই বহু পুরনো মদ সমাজতন্ত্রের আতঙ্ক নামক মদ পরিবেশন ট্রাম্পের বক্তৃতায়। তার কথা : তার শাসন ‘আমেরিকাকে ডুবন্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে। মহান আমেরিকার পুনরুত্থান ঘটেছে। সমাজতন্ত্রের হাতে আমেরিকার স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করা গেছে।’ সুলাইমানিকে হত্যার পরও তার হুমকি ইরানকে ধ্বংস করার।স
বিশ্ব এখন প্রভুত্ববাদী, বর্ণবাদী, উগ্রজাতীয়তাবাদী এক আগ্রাসী পরাশক্তির শাসনে দিনযাপন করছে। আর সেটা পূর্বোক্তদের উন্মাদ উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রযন্ত্র তথা রাষ্ট্রশাসন। আশঙ্কাকে সত্য প্রতিপন্ন করে সিনেটে রিপাবলিকান দলের আত্মঘাতী ভূমিকা ৫২-৪৮/৪৭ ভোটে অভিশংসন থেকে মুক্ত ট্রাম্প। রিপাবলিকান সিনেটররা ভেবে দেখেননি, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে এলে বিশ্বশান্তি ও মানব অস্তিত্বের জন্য কী ভয়ংকর হতে পারেন। ইতিমধ্যে তার বহু অপকর্মের তালিকার ঊর্ধ্বে দুটো বিষয় নিয়ে উল্লিখিত অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হ প্রথমত, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কংগ্রেসের কাজে বাধাদা এ দুই অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে। সম্ভবত দলীয় ভাবমূর্তি রক্ষার চিন্তায় ট্রাম্পবিরোধী রিপাবলিকান সদস্যও তার বিরুদ্ধে ভোট দেননি, আসন্ন নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে। সর্বশেষ কথাস আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ভোটাররা কি ট্রাম্পের অনাচারের কথা মনে রাখবেন?