প্যারোলে সরগরম রাজনীতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ বলে তার পরিবারের সদস্যরা বলছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিএসএমএমইউ উপাচার্য বরাবর আবেদনও করেছেন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকার চাইছে বিদেশ যাওয়ার শর্তে প্যারোলের আবেদন করলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা। এর বাইরে আর কোনো উপায়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে সায় নেই ক্ষমতাসীন দলের। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্যারোলে তারা খালেদা জিয়ার মুক্তি চান না। সংবিধান, আইন অনুযায়ী জামিন তার প্রাপ্য। এ প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথিত ফোনালাপ উত্তাপ ছড়াচ্ছে রাজনীতিতে।
প্রান্তডেস্ক:সম্প্রতি বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া কিছু খেতে পারেন না। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণহীন। হাঁটতে পারেন না। শ্বাসকষ্ট বেড়েছে।
এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানতেসংবাদমাধ্যমেরপক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক জিলন মিয়া সরকারের সঙ্গে। তিনি গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গত শনিবার তাকে দেখতে তার কেবিনেগিয়েছিলাম। খালেদা জিয়া ভালো আছেন। তার চিকিৎসা চলছে। আগামীকাল (আজ) আবার তাকে দেখতে যাব।’
এদিকে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাকে ফোন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের এ আবেদনটা জানাতে বলেছেন মৌখিকভাবে। তিনি সেটা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। তবে অন্য কোনো আপসরফার কথা অস্বীকার করেছেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়টি তারা আবেদন করতে পারেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। তবে প্যারোল কী কী কারণে দেওয়া যায় এবং দোষী বন্দিকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যায় কি না আর কী কী কারণে প্যারোলে মুক্তি চান সে বিষয়টা উল্লেখ করে তারা লিখিতভাবে কোনো আবেদন এখনো করেননি। আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। কিন্তু তারা বিচ্ছিন্নভাবে পরিবারের লোকজন ও দলের লোকজন, বেগম জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে কথা বলছেন। আনুষ্ঠানিক কোনো আবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত পাননি। তারা মুখে বলছেন মুক্তি চান, আবেদন করবেন, কিন্তু আবেদনটা লিখিতভাবে আসেনি।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাকে ফোন করেছি এমন তথ্য-প্রমাণ হাজির করুক ওবায়দুল কাদের।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে। আর সেই ইঙ্গিত তাদের দলের সাধারণ সম্পাদক দিয়েছেনও জানিয়ে ওই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের অবস্থান হলো মুক্তি মিলবে তবে প্যারোলে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমরাও মুক্তির ব্যাপারে আগের চেয়ে নমনীয়। কিন্তু আমাদের শর্তও মানতে হবে।
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে কাদেরের ফোনালাপের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর ওই নেতা বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে মুক্তির ব্যাপারে আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, তা মানা হলে মুক্তি প্রক্রিয়া এগোবে।
সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, মুক্তির বিষয়ে বিএসএমএমইউয়ে বসে আলোচনা হয়েছে, সেখানে কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হন সেই সময়ে এ আলোচনা হওয়ার কথা শুনেছি। ওই নেতা আরও বলেন, এ বছরটি মুজিববর্ষ হিসেবে উদযাপন করবে সরকার। এ বছরটিতে অনভিপ্রেত কোনো ঘটনা ঘটুক এবং তা নিয়ে কোনো ভোগান্তিতে পড়ুক সেটা চায় না শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার। তাই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে দেশের বাইরে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ দিতে রাজি ক্ষমতাসীনরা। তবে শর্তের বাইরে এ সুযোগ পাবে না বিএনপি।
প্যারোল চান না বিএনপি নেতারা : বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের আলোচনার বিষয় সম্পর্কে কিছু জানেন না বিএনপি নেতারা। তবে প্যারোলের আবেদন করলে সরকার বিবেচনা করবে বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্যারোলের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে চেয়ারপারসনের নিজস্ব এখতিয়ার। আমরা বিএনপি নেতারা নেত্রীর প্যারোল চাই না। আমরা চাই তার জামিন। প্যারোলে যদি মুক্তি নিতে হয় তাহলে এতদিন চেয়ারপারসন কেন জেল খাটবেন? আরও আগেই চেয়ারপারসন প্যারোলে মুক্তি নিতে পারতেন।’
তিনি বলেন, বিএনপি চায় সংবিধান অনুযায়ী জামিন খালেদা জিয়ার প্রাপ্য। কিন্তু সরকার আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন বাধাগ্রস্ত করছে। আমরা চাই নেত্রীর অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে তার জামিনে সরকার বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। অন্যথায় গুরুতর অসুস্থ নেত্রীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা সরকার করবে। চেয়ারপারসনের পছন্দের ডাক্তার ও হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা সরকার করলে ব্যয়ভার বিএনপি বহন করবে।
খালেদা জিয়াকে জামিন দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যবস্থা করে দেন, সেটাই হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে জাতির জন্য সরকারের সবচেয়ে বড় উপহার।’
তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি শারীরিক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। তাছাড়া জেলের ভেতরে একাকিত্বের কারণে প্রেসার, ডায়াবেটিস, কিডনিসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকার সদয় হলে আদালতের সামনে এগুলো তুলে ধরলে হয়তো মুক্তি মিলবে। বিচার বিভাগের এমন অবস্থা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর ইশারা ছাড়া চলেন না। তাই মানবিক কারণে হলেও প্রধানমন্ত্রীর উচিত খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া, সেটা প্যারোলে হোক আর এমনিতে হোক।’
গত বছর পহেলা বৈশাখের দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খান বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর আর তার সঙ্গে কোনো নেতার সাক্ষাৎ হয়নি। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, তারা আবেদন করলেও তাদের সাক্ষাতের অনুমতি দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ।