ধর্ম বিচারের কাজ মুসলমানের নয় : প্রধানমন্ত্রী
প্রান্তডেস্ক: কে মুসলমান, কে মুসলমান না, কে ধর্ম পালন করে, কে করে না, সে বিচার আল্লাহ করবেন। যে যা করবে তার ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। কারও ফল তো অন্য কেউ ভোগ করে দেবে না। এ অবস্থায় কেন এই রেষারেষিটা থাকবে? গতকাল বুধবার সংসদে এমন প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা যদি বিশ্বাস করি শেষ বিচার করবেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, কে বেহেশতে যাবে, কে দোজখে যাবে তা তো আল্লাহ নির্ধারণ করবেন। সেই বিচারটা এখন বান্দা কেন করবে।’
সম্পূরক প্রশ্নে নজিবুল বশর মাইজভারী বলেন, ‘মাইজভা-ারীকে নিয়ে বকাবকি হচ্ছে। আমরাও বকছি। আলেম-ওলামারা এখন চার ভাগে বিভক্ত। আহলে সুন্নাত আল জামাত, তরীকতপন্থি (সুফিবাদসহ), হেফাজতি পক্ষ ও আহলে হাদীস। আবার বক্তব্য দেওয়ার সময় সবাই মনে করছেন সবারটা সত্য। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলাম, আছি, থাকব। এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা দরকার। যেন কোরআন সুন্নাহর বাইরে যা ইচ্ছে কেউ বলতে না পারে। কোনো ধর্মকে আঘাত করে বলতে না পারে।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মের মধ্যে ভাগ করা, কে ভালো, কে ভালো না আমি জানি না। আমাদের নবী করিমও (সা.) এ কথা বলেননি। অথবা ইসলাম ধর্মও এ কথা বলেনি। আমি মনে করি আমাদের ইসলাম ধর্মে যারা বিশ্বাসী তারা যদি ইসলাম ধর্মকেই বিশ্বাস করে এবং নবী করিম (সা.)-এর বাণী যদি ধারণ করে ও মেনে চলে, তাহলে তো এই বিচারের পথে কেউ যেতে পারে না। আল্লাহ তো বারবার বলেছেন, কোরআনেও বলা আছে শেষ বিচার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন করবেন। সেই ধৈর্যটা থাকবে না কেন। আমি বলব যারা সত্যিকার অর্থে ইসলাম বিশ্বাস করে তারা প্রত্যেকেই যার যার ধর্ম সেই সেই পালন করবে।
শেখ হাসিনা বলেন, কারও ধর্মে আঘাত দিয়ে কথা না বলা, মুসলমান হয়ে মুসলমানকে আঘাত না করা, অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও আঘাত না করা, এটাও ইসলামের শিক্ষা। সুরা কাহাফে স্পষ্ট বলা আছে। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। যার যার ধর্ম সেই সেই পালন করবে। সেই বিশ্বাস নিয়ে চললে এই দ্বন্দ্বটা থাকে না। সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধে ইউজিসি ব্যবস্থা নিতে পারে
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ ও প্রয়োজনে আইন করার বিষয়ে জানতে চান জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট বেশি থাকায় দুই শিফটে পড়ানো বা সান্ধ্যকালীন কোর্সে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটা ঠিক যে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা নিজের প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে যতটা না আন্তরিক, বেসরকারি কোথাও ক্লাস নিতে তার চেয়ে বেশি আন্তরিক হয়ে পড়েন। তাতে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে মাঝেমধ্যে সমস্যা হয়। তবে সেগুলো আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে আসছে। সান্ধ্যকালীন কোর্সের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিও উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে যাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেটা আমরা দেখছি। তবে এজন্য আইন করার প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয় সবকিছুতে আইন লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ অথবা ইউজিসি ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা কোনো বিষয় নয়। এ বিষয়টা আমরা দেখব কেন সমস্যা দেখা দিচ্ছে।’
চট্টগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেন বিপথগামী হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতন করার লক্ষ্যে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কি না এবং করলে তা কী?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেন বিপথগামী হয়ে জঙ্গিবাদে না জড়িয়ে পড়ে, সেজন্য আমরা শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এগুলোর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জঙ্গিবাদবিরোধী নানামুখী সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা; যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শনাক্ত; অনুপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে অনুপস্থিতির কারণ সন্দেহজনক হলে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমাজের গণ্যমান্য ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে সন্ত্রাসী ও ধর্মের নামে জঙ্গিবাদবিরোধী সভা; শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে ও নৈতিক শিক্ষা প্রদানে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
জঙ্গি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেন কোনোভাবে সম্পৃক্ত থাকতে না পারে, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ চালু হওয়ার ফলে অন্যান্য অপরাধের মতো জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় জঙ্গিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংরক্ষিত আসনের আরমা দত্তের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা জানান, ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নানা কারণে আউট পাস নিয়ে ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫০২ জন কর্মী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন।
নারী কর্মীদের সহায়তার জন্য গত বছর ডিসেম্বরে ‘নারীকর্মী সুরক্ষা সেল’ গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সুরক্ষা সেল গঠনের পর নারী কর্মীদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বেশি কার্যকর হওয়ায় গত এক মাসে একজন নারী কর্মীকেও দুর্ভোগের শিকার হতে হয়নি।
চট্টগ্রাম-১১ আসনের এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমানে মোবাইল গ্রাহক ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৯ কোটি ৯১ লাখ। টেলিডেনসিটি ৯৯.২৪% আর ইন্টারনেট ডেনসিটি ৫৯.০৮%।
যশোর-২ আসনের নাসিরউদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতায় ২২ হাজার ৯৬ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৪৩ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম সড়ক মিলে ১ লাখ ২১ হাজার ৮৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক রয়েছে।
ইংলিশ মিডিয়াম থেকে পাস করা ‘মেধাবীরা’ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাননীয় সংসদ সদস্যের কথায় মনে হচ্ছে, ইংরেজি মিডিয়ামে পড়লেই মেধাবী আর বাংলা মিডিয়ামে যারা পড়ে তারা মেধাবী নয়। আমরা কিন্তু নিরেট বাংলা মিডিয়ামে পড়ে আসছি। হয়তো মেধাবী না, তবে একেবারে খারাপ যে তাও না। আরেকটু ভালো পড়ার সুযোগ পেলে ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম। ইংরেজি মিডিয়ামে যারা পড়ছে তাদের জন্য কেন কোটা রাখতে হবে? কোটা রাখার যৌক্তিকতা দেখি না। বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের মাঝে আছে। একটা প্রবণতা আছে, যেনতেনভাবে পাস করলেই যেন একটা চাকরি পেয়ে যাবে। আমার একটা কথা হচ্ছে, সবাই চাকরির পেছনে ছুটবে কেন? বরং আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা মেধাবী তারা নিজেরাই কিছু করবে, যাতে আরও ১০ জনকে চাকরি দিতে পারে। সেজন্য আমরা একটা আইন করে অর্থও রেখেছি। একটা ফান্ড করা হয়েছে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে তারা কাজ করে নিজেরা উপার্জনের পথ করতে পারে, আরও ১০ জনকেও কাজ দিতে পারে। চাকরির প্রবণতাটা বিদেশে খুব বেশি নেই। আমাদের এখানে বেশি। এ প্রবণতা কমিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে করার দিকে মনোযোগ দিলে কোনো সমস্যা হয় না।