সমাজ পরিবর্তনে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকর্মী
(গতকালের পর)
গরিব মানুষের, মেহনতি মানুষের, সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি ছাড়া। গরিব মানুষ ভোট দিল ১৯৪৬ সালে। পাকিস্তান হলো। কিন্তু তার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। সে ভোট দিয়েছে ৫৪ সালে। যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়েছে, পাকিস্তানের যে আদর্শ তার বিরুদ্ধেই সে ভোট দিয়েছে। কিন্তু ৫৪ সালের নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট কী করেছে, তা আমরা দেখেছি। যুক্তফ্রন্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে, মারামারি করেছে, স্পিকার শাহেদ আলীকে অ্যাসেম্বলি ভবনের মধ্যে তারা হত্যা করেছে। সামরিক শাসন আসার জন্য পথ করে দিয়েছে। তারপর আবার ১৯৭০ সালে মানুষ ভোট দিয়েছে। সেই ভোটেও বাংলাদেশের জন্ম হয়নি, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে যুদ্ধের দ্বারা। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগে, নারীর সম্ভ্রম হারিয়ে আমরা এই রাষ্ট্র পেয়েছি। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কারা করছে? করছে ধনীরা।
এরশাদ যে শুধু জাতীয় পার্টিতে ছিলেন তা নয়। পতিত এরশাদের লোকরা, তার আমলারা, তারাই এখন নানা জায়গায় বর্তমান সরকারের শাসনামলে রয়েছে। তারাই ঘুরেফিরে আসছে। এরশাদের আমলা, পাকিস্তানের আমলা, তার আগের ব্রিটিশের আমলারা, ব্যবসায়ীরা তারাই এ দেশ শাসন করেছে, সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসেবে এবং আমাদের গ্যাস, তেল, বিদ্যুৎ, বন্দর এরা সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দিচ্ছে।
সবাই বলছে, দেশে আজ মীরজাফর হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। সেটা সত্য, আরেকটা কথাও সত্য যে, পলাশীর যুদ্ধের সময় অন্তত একজন সিরাজ-উদ্-দৌলা জীবিত ছিলেন। সিরাজ-উদ্-দৌলা কত বড় রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, তার চরিত্র কেমন ছিল, এসব বিষয়ে জ্ঞান জরুরি নয়। জরুরি হলো এই সত্য যে, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। আজকের বাংলাদেশে কোনো সিরাজ-উদ্-দৌলা নেই। রাজা-বাদশাহরা সবাই মীরজাফরে পরিণত হয়েছেন। জিমি কার্টার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি এসেছেন এনজিওর প্রধান হয়ে। আমাদের দুই নেত্রী তার কাছে অঙ্গীকার করলেন যে, তারা হরতাল করবেন না, নির্বাচনের ফলকে মেনে নেবেন। একজন মন্ত্রী আবার এই ফাঁকে বলেও দিলেন, তেল, গ্যাসের কথা তাদের মনে আছে। দুই পক্ষ এরপর প্রতিযোগিতা করবে কে কত সুবিধাজনক শর্তে ওই সব সম্পদ তাদের হাতে তুলে দিতে পারে তা নিয়ে। তুলে দেবে নিজেদের স্বার্থে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আছে এ কথা দেশের শাসকরা বিশ্বাস করেন না। যেমন করে ব্রিটিশরা এ দেশকে লুণ্ঠন করত, যেমন করে পাকিস্তানিরা লুণ্ঠন করত, আজকে বাঙালি বিত্তবানরা সেভাবেই এ দেশ লুণ্ঠন করছে। তাদের জন্য আমেরিকা আছে। নিজেরা ছয় মাস আমেরিকায় থাকে, ছয় মাস এ দেশে থাকে; কোনো সময় বিপদ দেখলে কেটে পড়বে; এখানে যাতে আরও লুণ্ঠন করা যায় তাই নির্বাচন করবে এবং নির্বাচিত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে যে মুক্তি আসবে না, তা আমাদের সংস্কৃতিকর্মীরা সবাই বোঝেন। আমরা ৪৬ সালে নির্বাচন দেখেছি। ১৯৪৫-৪৬ সালে সারা বাংলায় প্রায়-বিপ্লবী অবস্থা বিরাজ করছিল। বামপন্থিরা তখন ভুল করেছেন। মারাত্মক ভুল, হৃদয়বিদারক ভুল।
রাজনীতিতে একসময় অনেক দ্বন্দ্ব থাকে কিন্তু একটা প্রধান দ্বন্দ্বও থাকে। ব্রিটিশ আমলে প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। বামপন্থিরা তা জানতেন। কিন্তু ব্রিটিশকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে তারা ব্যর্থ হলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার কারণে। সেই ব্যর্থতার দরুন তারা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরও বামপন্থিরা এগিয়েছেন। আন্দোলন হচ্ছিল। কলকাতায় শ্রমিকরা ধর্মঘট করছে, ছাত্র-শ্রমিকরা একসঙ্গে হয়ে যাচ্ছে, ভিয়েতনাম দিবস পালিত হচ্ছে, ছাত্ররা শহীদ হচ্ছে, তেভাগা আন্দোলন হচ্ছে উত্তরবঙ্গে। সেই প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতিতে সব আন্দোলন যাতে স্তব্ধ করে দেওয়া যায় সেই লক্ষ্যে নির্বাচন দেওয়া হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। সে নির্বাচনের কানাগলিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষকে। মানুষ মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস, দুভাগে ভাগ হয়েছে, খুনোখুনি করেছে। ভাই ভাইকে খুন করেছে এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়েছে। এই দাঙ্গার পরিণতিতে বাংলা বিভক্ত হয়েছে। সর্বনাশা সেই বিভাজন সাধারণ মানুষ করেনি। বিভাজন আন্দোলনকারীরা করেনি, বামপন্থিরা করেনি, সেই বিভাজন করেছে মধ্যবিত্তরা, হিন্দু মধ্যবিত্ত ও মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজেদের স্বার্থে বাংলাকে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। তারপর আমরা দেখলাম, একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। সেই নতুন রাষ্ট্রে মধ্যবিত্তের সুবিধা হলো।
আমরা ৫৪ সালে নির্বাচন দেখলাম। সেই নির্বাচনের আগে ৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক এ কারণে যে, ওই আন্দোলন পাকিস্তানের আদর্শকে পরিত্যাগ করে এ কথা বলে দিয়েছে যে, ধর্ম জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি নয় এবং বাঙালিরা বাঙালি হিসেবে বাঁচতে চায়। আন্দোলন তখনো একটা বিপ্লবী পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছিল। তারপর ৫৪ সালের নির্বাচন হয়েছে। তার পরিণতি আমরা দেখেছি। ৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। অভ্যুত্থান করে মানুষ বিপ্লবী পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখে আতঙ্কিত শাসকশ্রেণি আবার নির্বাচন দিয়েছে, শাসকরা আশা করেছিল নির্বাচনে তারা বিভাজন সৃষ্টি করতে পারবে। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। কিন্তু কোনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি, সব মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছে। সেজন্য ক্ষেপে গিয়ে ভোটের ফলাফলকে নাকচ করার চেষ্টা তারা করেছে। তখন যুদ্ধ করতে হয়েছে মানুষকে। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করে এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল।
বোঝা যাচ্ছে নির্বাচনে মুক্তি আসবে না। নির্বাচনে বড় দুই দলের একদল যে নির্বাচিত হবে, তা পূর্বনির্ধারিত। অধুনালুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তারই ব্যবস্থা করত। মানুষের মুক্তি আসবে আন্দোলনে, সে আন্দোলনকে সর্বাত্মক আন্দোলন হতে হবে। সে আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলন হবে। সংস্কৃতিকর্মীদেরও ওই আন্দোলনের জায়গাতে যেতে হবে। সংস্কৃতিকর্মীরা সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশ। আমরা সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় যোগ্যতা অর্জন করেছি। যেমন আমরা গান গাই, কবিতা লিখি, ছবি আঁকি, তবলা বাজাই, কিন্তু এর বাইরে আমাদের আরও একটি বিষয় আছে তা হলো সচেতনতা। সেই সচেতনতা আদর্শবাদী সচেতনতা, যা আজ বাংলাদেশে খুব বেশি প্রয়োজন। সংস্কৃতিকে যারা মোটেই আদর্শনিরপেক্ষ মনে করে না, যারা মনে করে মানবিক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার; যারা পুঁজিবাদী সংস্কৃতিকে, এই মুনাফাকেন্দ্রিক, বাজারকেন্দ্রিক, ব্যক্তিগত উপভোগকেন্দ্রিক, প্রমোদকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে পরিত্যাগ করে সুস্থ-স্বাভাবিক মিলনের যে সংস্কৃতি, সংগ্রামের যে সংস্কৃতি, উন্নত জীবনের যে
সংস্কৃতিকে লালন করতে চায়, বিকশিত করতে চায়, যারা স্থানীয় এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সেই সংস্কৃতির চর্চা করে তারা বাম ধারার লোক। আগামী দিনে এই কাজ তাদেরই করতে হবে।
সংস্কৃতি অত্যন্ত মূল্যবান। সংস্কৃতি রাষ্ট্রের চেয়েও স্থায়ী। রাষ্ট্র আসে এবং যায়, সমাজেও পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু সংস্কৃতি পারে মানুষকে ধরে রাখতে, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে। সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের ছবি প্রতিফলিত হয়, সংস্কৃতি আমাদের প্রত্যেককে উন্নত করে, স্বাভাবিক করে, সুস্থ রাখে। এই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আদর্শ খুব জরুরি এবং আদর্শের ক্ষেত্রে বারবার বুঝতে হবে যে, প্রধান দ্বন্দ্বটা কার সঙ্গে কার। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষীয়দের প্রধান দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ছিল, সেই সাম্রাজ্যবাদ আজও আছে। পাকিস্তান আমলে যে পুঁজিবাদ ছিল আজও তা আছে। পুঁজিবাদ তার নানা চেহারায় আগ্রাসন চালাচ্ছে। আজকের বাংলাদেশ বাংলা ভাষার আন্দোলন থেকে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু বাংলা ভাষার অবস্থা বেশ করুণ। মাতৃভাষাকে মাধ্যম করে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। দেশে তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে এবং কারা কোন শিক্ষা পাচ্ছে তা আমরা জানি। ধনীদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, মধ্যবিত্তরা পড়ছে বাংলা মাধ্যমে এবং গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসায় পড়ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা একটা অভিশাপ, যা এই শাসকশ্রেণি জানে। এই অভিশপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে তারা সাধারণ মানুষকে আটকে রাখছে। গরিব মানুষ নিজেদের ছেলেমেয়েদের উন্নত বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে না। তাই এরা প্রায় বিনা পয়সায় পড়ানোর জন্য মাদ্রাসায় পাঠায়। মাদ্রাসায় পাঠিয়ে তারা সন্তানদের আরও গরিব করে। এভাবে গরিব মানুষকে একটা বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। তাদের ভিন্ন পথে, তথাকথিত আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করা হচ্ছে, তারা সন্ত্রাসীতেও পরিণত হচ্ছে। এটা একটা ষড়যন্ত্র, এটা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ধনী শ্রেণির ষড়যন্ত্র।
মানুষের মুক্তিকে সম্ভব করার লক্ষ্যে যে বিপ্লবের কথা আমরা ভাবছি, তাকে একটা সর্বাত্মক বিপ্লব হতে হবে, যা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সে-বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজে বিপ্লব আনতে হবে এবং সামাজিক বিপ্লবকে ধরে রাখার জন্য, বিকশিত করার জন্য, স্থায়ী করার জন্য
সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন হবে। এতে মধ্যবিত্তের ভূমিকা থাকবে। কিছু বিপ্লবকামী মধ্যবিত্তকে শ্রেণিচ্যুত হতে হবে। সেই ভূমিকায় সমষ্টিগত স্বার্থ থাকবে এবং তাকে আদর্শবাদিতায় ধনী হতে হবে। এটা কোনো করুণার ব্যাপার নয়। সমাজ-পরিবর্তনকামীরা যখন মেহনতি মানুষের কথা বলে, সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের কথা বলে, তখন করুণা করে বলে না। ধনীরা করুণা করে, তারা ভিক্ষা দিতে চায়। আর যারা বিপ্লবে বিশ্বাস করে, পরিবর্তনে বিশ্বাস করে তারা দেখছে, পুঁজিবাদ সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না। পুঁজিবাদ গরিব মানুষকে আরও গরিব করছে, ধনী-গরিব সবাইকে স্বার্থবাদী করছে, ভোগবাদী করছে। অপরাধ বাড়ছে, আমাদের বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা বাস্তব সত্য, এটা আকাশ থেকে নেমে আসেনি বা কারও অভিশাপে সম্ভব হয়নি। এটা এসেছে শাসকশ্রেণির যে দুর্নীতি, তাদের যে অপরাধ-প্রবণতা সেখান থেকে। এই যে পুলিশ দেখছি, আগেও তারা ঘুষ খেত, কিন্তু আগেকার পুলিশ দেখলে মানুষ যত না ভয় পেত, এখন পায় তার দ্বিগুণ। ধনিক শ্রেণি সবকিছুকে পচিয়ে দিয়েছে, নষ্ট করে দিয়েছে, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য একটা বৈষম্যহীন সমাজ চাই, শোষণমুক্ত ব্যবস্থা চাই, যে সমাজ বর্তমান এই সমাজের বিকল্প হবে, উন্নত সমাজ হবে; অবনত নয়, পশ্চাৎপদ নয়, নিম্নগামী নয়, আরও উন্নত। সে সমাজ পুঁজিবাদী সমাজকে ছাড়িয়ে যাবে। সেখানে আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, সবকিছুকে ধারণ করে পুঁজিবাদী সমাজের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক এক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অর্জনগুলো ব্যক্তিমালিকানায় থাকবে না, সামাজিক হবে।
এই পরিবর্তনে মেহনতি মানুষের ভূমিকা দরকার। তারাই সংখ্যায় অধিক এবং উৎপাদনে তাদের ভূমিকাই মুখ্য। মধ্যবিত্তকে ওই জায়গায় যেতে হবে এই জ্ঞান নিয়ে যে, সাধারণ মানুষের চেতনায় স্তরটা নিচু। সাধারণ মানুষের মধ্যে জিজ্ঞাসা তেমন নেই, সেখানে ধর্ম আছে। সেখানে জিজ্ঞাসা নেই, বোঝার শক্তি নেই, পীড়া আছে। সেই মানুষকে সচেতন করে এবং তাদের সচেতনতাকে এগিয়ে নিয়ে তবেই আমরা এই পরিবর্তন আনতে পারব।
পরিবর্তনটা যে শুধু বাংলাদেশে হবে, তা নয়। পৃথিবীকেই পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তার জন্য পৃথিবীব্যাপীতে যে আন্দোলন চলছে আমরা তারই অংশ। তাদের যে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম তা আমাদেরও সংগ্রাম। পুঁজিবাদ আগ্রাসন করছে। সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিকল্প যে শক্তি সেই শক্তিকে বিকশিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যেই আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের ঐক্যের প্রয়োজন।
বৈচিত্র্যের মধ্যেও আমাদের ঐক্য থাকতে হবে। বৈচিত্র্য থাকবে নানাবিধ। কিন্তু ঐক্য থাকবে আদর্শগত, ঐক্য থাকবে দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমরা মানবিক সংস্কৃতি চাই। আমরা মুনাফালব্ধ সংস্কৃতি চাই না। যে বর্জ্য পশ্চিমারা নিক্ষেপ করে তা চাই না। সেই অশ্লীলতা, মাদকাসক্তি আমরা বর্জন করতে চাই। আজ মাদকাসক্তি কী ব্যাপক আকার ধারণ করেছে সে তো সবাই জানি। মাদকাসক্তি এমনিতে ঘটেনি। এটা সমাজ থেকে ঘটছে। হতাশা থেকে ঘটছে। বামপন্থি আন্দোলনের এক তরুণকে আমি জানি। সে বামপন্থি আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিল। কিন্তু মাদকাসক্ত হয়ে আজ তার প্রাণের সংশয় দেখা দিয়েছে। কেননা আজ ওই আদর্শবাদিতা তার সামনে নেই, ওই আন্দোলন তার সামনে নেই।
আন্দোলন ছাড়া মানুষের জন্য ভরসার কোনো জায়গা নেই। আন্দোলন ছাড়া ভবিষ্যৎ নেই, আন্দোলন ছাড়া আশা নেই, আশাকে জাগিয়ে রাখতে হলে মেরুদণ্ডকে সোজা রাখতে হবে। যে-মেরুদণ্ড শত শত বছরের অত্যাচারে, নিপীড়নে নত হয়ে গেছে, তাকে শক্ত করার জন্যও আকস্মিক আন্দোলন দরকার। এর মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে পারব। তাই সাংস্কৃতিক আন্দোলন এত বেশি জরুরি, সংস্কৃতিকর্মীদের এত বেশি প্রয়োজন। এই আন্দোলন রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। রাজনীতিটা সুস্পষ্ট। এটা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে একটা মানবিক ব্যবস্থা কায়েম করার রাজনীতি।
এই রাজনীতিকে ধারণ করে তবেই সব মানুষের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য অব্যাহত কর্মের প্রয়োজন। মাঝেমধ্যে জেগে ওঠা নয়, কর্মের একটা অব্যাহত ধারা বজায় রাখা চাই। পরিবর্তন এই ধারার মধ্য থেকেই আসবে। অনেক মানুষ অপেক্ষা করে আছে। তারা জায়গা চাচ্ছে, ডাক শুনতে চাচ্ছে। বিকল্প শক্তি চাচ্ছে। সেই বিকল্প শক্তি অবশ্যই রাজনৈতিক হবে। কিন্তু তার পেছনে সংস্কৃতি থাকবে, আদর্শ থাকবে। সংস্কৃতি কেবল বুদ্ধির ব্যাপার নয়। সংস্কৃতি হৃদয়েরও ব্যাপার। মানুষকে আমরা কেবল বুদ্ধি দিয়ে পরিচালিত করতে পারব না, মানুষের হৃদয়ে অন্ধকার আছে, অন্ধ আবেগ আছে, বিশৃঙ্খলা আছে। সেই হৃদয়কে শিক্ষিত করার কোনো আয়োজন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। কোনো পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাতেই মানুষের হৃদয়কে শিক্ষিত করা, অন্য মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, বিপ্লবী চেতনা, অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করার ক্ষেত্র নেই। আমরা হৃদয়কে সমৃদ্ধ, সক্ষম, দক্ষ করে তুলতে পারি এবং ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। বুদ্ধির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে, বুদ্ধির দ্বারা আমরা বুঝব, বৈজ্ঞানিক হব, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার হৃদয়বানও হব। বুদ্ধি ও হৃদয়ের যে সম্মেলন, তা আমরা আমাদের গান, নাটক, লেখা, চারুকলা সবকিছুর মাধ্যমে প্রতিফলিত করব। এভাবেই আমরা উন্নত সমাজ গঠনের দিকে এগোব। মানুষ আজ অপেক্ষা করছে এই অব্যাহত আন্দোলনের জন্য।
(সমাপ্ত)
লেখক
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়