আগামী কাল( ১৯মে) বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদ দিবস
প্রান্তডেস্ক:আগামীকাল ১৯মে।১৯৬১সালের এদিনে ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় মায়ের ভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় সম্মান রক্ষার্থে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করতে গিয়ে শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১ জন ভাষাসৈনিক।সেই ভাষা সৈনিকদের জানাই লাল সেলাম।তুলে ধরলাম শিলচরের্ ১১ভাষা সৈনিকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
বরাক উপত্যকার ভাষাশহীদ পরিচিতি—
১. কমলা ভট্টাচার্য: বাংলাভাষা সংগ্রামের একমাত্র নারী শহিদ কমলা ভট্টাচার্য মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েই ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ষোল বছর বয়সে তিনি শহিদ হন। পিতৃহীন কমলা ছিলেন অবিবাহিতা, থাকতেন ভাই রামরমণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিলচর শহরে। তাদের পরিবার ১৯৫০ সালে সিলেট ছেড়ে কাছাড়ে আশ্রয় নেন। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে কমলা ছিলেন তৃতীয়।
২. শচীন্দ্রমোহন পাল: মাত্র উনিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুকে গুলি পেতে নিয়েছিলেন শচীন্দ্র পাল। তাদের পূর্বনিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবিগঞ্জের সন্দনপুর গ্রামে। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। কাছাড় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন।

৩. কানাইলাল নিয়োগী: আদিনিবাস ময়মনসিংহ জেলার খিলদা গ্রামে। মেট্রিক পাশ করে ১৯৪০ সালে রেলে চাকরি নেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শহিদ হন। তখন তার মা শান্তিকণা নিয়োগীর বয়স ৭০ বছর। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী আগেই প্রয়াত।
৪. কুমুদ দাস: পিতা কৃষ্ণমোহন দাস মৌলভিবাজারের জুরি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কাছাড়ে যান। মায়ের মত্যুর পর আট বছর বয়সে কুমুদ দাস ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম.ই. পর্যন্ত পড়ে গাড়িচালকের পেশা গ্রহণ করেন। পরে শিলচরের তারাপুরে চা-দোকানে বয়ের কাজ নেন। বৃদ্ধ পিতা, চার বোন ও এক শিশু ভাইকে নিয়ে সংসার ছিল তাদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন কুমুদ দাস।
৫. তরণী দেবনাথ: ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন পিতা যোগেন্দ্র দেবনাথ। মৃত্যুকালে ব্যবসায়ী তরণীর বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর।
৬. হীতেশ বিশ্বাস: বাস্তহারা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিতৃহীন হীতেশ বিশ্বাস মাত্র বারো বছর বয়সে ত্রিপুরার খোয়াই শহরের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা হন। মা, ছোট ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল তাদের। শিলচর শহরে ভগ্নিপতির বাসায় অবস্থানকালে মাতৃভাষার জন্য জীবনদান করেন।
৭. চন্ডীচরণ সূত্রধর: পিতৃহীন চন্ডীচরণ সূত্রধর ১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকেরপুর গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেন শিলচরে। পড়াশোনা এম.ই. পর্যন্ত। জীবিকা হিসেবে পৈতৃক বৃত্তি কাঠমিস্ত্রির কাজেই নিয়োজিত করেন নিজেকে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভাষার জন্য আত্মদান করেন। তিনি তখন একা শিলচরের রাঙ্গির খাড়িতে বাস করতেন।
৮. সুনীল সরকার: ঢাকার মুন্সিবাজারের কামারপাড়া থেকে ভারত বিভাজনের বলি হয়ে শিলচর শহরের নূতন পট্টিতে গিয়ে ঘর বাঁধেন সুনীল সরকারের পিতা সুরেন্দ্র সরকার। ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রের তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে সুনীল ছিলেন সবার ছোট। মাত্র এম.ই. পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সুনীল।
৯. সুকোমল পুরকায়স্থ: করিমগঞ্জের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিতা সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রুগড়ে ব্যবসা করতেন। অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে ‘বাঙ্গাল খেদা’ অভিযানের শিকার হয়ে সপরিবারে স্বগ্রামে চলে আসেন। ভাষা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধ করেন সুকোমল।
১০. বীরেন্দ্র সূত্রধর: শৈশবে বাস্তুহারা হয়ে পিতামাতার সঙ্গে হবিগঞ্জের নবিগঞ্জের বহরমপুর গ্রাম থেকে শিলচর যান। জীবিকার অন্বেষণে বর্তমান মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির পেশা অবলম্বন করেন। বিয়ে করেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে। পরে কাছাড় জেলায় অবস্থিত মণিপুর চা বাগানের কাছে ঘর ভাড়া নেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রী ও এক বছর বয়সী কন্যা রেখে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে আত্মদান করেন তিনি। শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১১. সত্যেন্দ্রকুমার দেব: মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেন। উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় নূতন রাজনগর কলোনিতে তিন বোন ও মাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পিতৃহীন সত্যেন্দ্র। মা ও বোনকে সেখানে রেখে জীবিকার অন্বেষণে শিলচরে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পড়াশোনা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। তার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ২০ মে শিলচর রেল স্টেশনের পুকুর থেকে।
আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিরা আজও বঞ্চিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য ছোট ছোট জনগোষ্ঠী পৃথক রাজ্য পেলেও বরাক থেকে দাবিটুকুও উঠছে না সেভাবে। জনসংখ্যার নিরিখে বরাক যদি পৃথক রাজ্য হয়, তবে সেটা হবে উত্তর-পূর্ব ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। বর্তমানে এই অঞ্চলের আট রাজ্যের মধ্যে ৩৮ লাখের ত্রিপুরা দ্বিতীয় বৃহত্তম। বরাকের লোকসংখ্যা ৪২ লাখেরও বেশি।এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।