দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করা হয় আজকের দিনে
প্রান্তডেস্ক:বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বাংলাদেশের প্রথম ভূস্থির যোগাযোগ উপগ্রহ যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ। এটি ২০১৮ সালের ১১ মে (বাংলাদেশ সময় ১২ মে) কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ৫৭ তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যোগ হয় বাংলাদেশ। এই প্রকল্পটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক বাস্তবায়িত হয় এবং এটি ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ রকেটের প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ ছিল।
ইতিহাস
২০০৮ সালে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এরপর ২০০৯ সালে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিটের (আইটিইউ) কাছে ইলেক্ট্রনিক আবেদন করে বাংলাদেশ। কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবস্থার নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’ কে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্যাটেলাইট সিস্টেম কিনতে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে এক হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে বিটিআরসি। ২০১৫ সালে বিটিআরসি রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনার আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে।
২০১৭ সালে কৃত্রিম উপগ্রহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। এই সংস্থার প্রাথমিক মূলধন হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
নির্মাণ ব্যয়[
কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনার জন্য ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একনেক সভায় দুই হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া ‘বিডার্স ফাইন্যান্সিং’ এর মাধ্যমে এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হংক সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) সাথে সরকারের প্রায় একহাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়।এক দশমিক ৫১ শতাংশ হার সুদসহ ১২ বছরে ২০ কিস্তিতে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার সংস্থা ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে অরবিটাল স্লট অনুমোদন দেওয়া হয়। এর অর্থমূল্য ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
বিবরণ
বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি ১১৯.১° ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার ভূস্থির স্লটে স্থাপিত হবে। এটিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ফ্রান্সের থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস কর্তৃক নকশা ও তৈরি করা হয়েছে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিমালিকানাধীন মহাকাশযান সংস্থা স্পেস এক্স থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪০টি কে-ইউ এবং সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার বহন করবে এবং এটির আয়ু ১৫ বছর হওয়ার কথা ধরা হয়েছে। স্যাটেলাইটের বাইরের অংশে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার রঙের নকশার ওপর ইংরেজিতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু ১। বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও সেখানে রয়েছে।
উপগ্রহের অবস্থান মানচিত্র
কারিগরি বৈশিষ্ট্য
বিএস-১ উপগ্রহটি ২৬টি কে-ইউ ব্যান্ড এবং ১৪টি সি ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার সজ্জিত হয়েছে ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার কক্ষপথের অবস্থান থেকে। কে-ইউ ব্যান্ডের আওতায় রয়েছে বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগরে তার জলসীমাসহ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল। সি ব্যান্ডেরও আওতায় রয়েছে এই সমুদয় অঞ্চল।
উৎক্ষেপণ
স্পেসএক্স ফ্যালকন ৯ উৎক্ষেপণ যানে করে ১১ মে ২০১৮ সফলভাবে বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ফ্যালকন ৯ রকেটের নতুন ব্লক ৫ মডেল ব্যবহার করে প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ ছিল।
বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ ঠিক করা হয়, তবে হারিকেন ইরমার কারণে ফ্লোরিডায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে তা পিছিয়ে যায়। ২০১৮ সালেও কয়েক দফা উৎক্ষেপণের তারিখ পিছিয়ে যায় আবহাওয়ার কারণে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে উৎক্ষেপণ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৪ মে ২০১৮ তারিখে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে দুই পর্যায়ের এই রকেটের স্ট্যাটিক ফায়ার টেস্ট সম্পন্ন হয়। কৃত্রিম উপগ্রহটি ১০ মে ২০১৮ তারিখে উৎক্ষেপণের তারিখ ঠিক করা হয়; কিন্তু ১০ মে উৎক্ষেপণের সময় t-৫৮ সেকেন্ডে এসে তা বাতিল করা হয়। শেষ মিনিটে কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়। অবশেষে এটি ১১ মে উৎক্ষেপণ করা হয়।
কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণ করার পর, বাংলাদেশ ১২ মে ২০১৮ তারিখে এটি থেকে পরীক্ষামূলক সংকেত পেতে শুরু করে।
ভূ কেন্দ্র
বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের ভূ-কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় ভূকেন্দ্র তৈরি করা হয়। জয়দেবপুরের ভূ-কেন্দ্রটি হল মূল স্টেশন। আর বেতবুনিয়ায় স্টেশনটি দ্বিতীয় মাধ্যম ব্যকআপ হিসেবে রাখা হয়। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে দুটি ভূ-উপগ্রহ উপকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।
ব্যবহারকারী দেশসমূহ
বাংলাদেশের সংস্থার পাশাপাশি বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের বিভিন্ন মিডিয়া সংস্থা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু -১ স্যাটেলাইট থেকে ভাড়া নেয়া ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার করছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- হন্ডুরাস – ২টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল
- তুরস্ক – ১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল
- ফিলিপাইন – ১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল (আরও একটি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে)
- ঘানা – ২ টিভি চ্যানেল (আরও একটি সম্প্রচারের অপেক্ষায়)
- ক্যামেরুন – ১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল
- দক্ষিণ আফ্রিকা – ২টি অনলাইন ভিত্তিক টিভি চ্যানেল
সুযোগ-সুবিধা
সুবিধা
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে ৩ ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে।
- টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্যাটেলাইট ভাড়া করে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট চ্যানেলের সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। আবার দেশের টিভি চ্যানেলগুলো যদি এই স্যাটেলাইটের সক্ষমতা কেনে তবে দেশের টাকা দেশেই থাকবে। এর মাধ্যমে ডিটিএইচ বা ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস চালু সম্ভব।
- বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মোট ফ্রিকোয়েন্সি ক্ষমতা হলো ১ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ। এর ব্যান্ডউইডথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেট বঞ্চিত অঞ্চল যেমন পার্বত্য ও হাওড় এলাকায় উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা দেয়া সম্ভব।
- বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়ে। তখন এর মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে।
অসুবিধা
- বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রধান অসুবিধা হচ্ছে রাষ্ট্র এ থেকে তেমন অর্থ আয় করতে পারছে না।