লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, , বেহালাবাদক ও সুরকার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী’র প্রয়ান দিবস আজ
প্রান্তডেস্ক:ছোটবেলায় কখনো না কখনো টুনটুনির গল্প আমরা অনেকেই হয়তো শুনেছি। ছোটদের কাছে জনপ্রিয় এই গল্পটির রচয়িতা হচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পিতা এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদাদা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এই দুই পরিচয় না দিলেও সবাই এক নামে উপেন্দ্রকিশোর রায়কে চিনবেন। আমাদের ছোটবেলা এবং ছোটবেলার গল্পের রাজ্যে প্রবেশ শুরুই হয়েছিল তার হাত ধরে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। কলকাতার বিখ্যাত সন্দেশ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন যা পরে তার পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন।
বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ছুঁয়ে কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে ১৮৬৩ সালের ১২ মে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। উপেন্দ্রকিশোরের পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তার পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভাল ফল করলেও ছোটবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকেও বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে।
বিএ পাস করার পর ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ায় তার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখতে শুরু করেন। সেই সময়কার সখা, সাথী, মুকুল ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তার লেখা প্রকাশ হতে শুরু হয়।
উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ বইটি বেশ সমাদৃত হয়। কিন্তু এর মুদ্রণ নিয়ে তিনি সন্তুষ্ঠ হতে পারেননি। তাই ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্র আমদানি করেন। ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে ছাপাখানা খোলেন। সেখানে একটি কক্ষে ছবি আঁকার স্টুডিও করেন এবং হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। ফটোগ্রাফী ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য ১৯১১ সালে বড় ছেলে সুকুমারকে ইংল্যান্ডে পাঠান।
উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বছর দুইয়ের ছোট। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুও রবীন্দ্রনাথের বন্ধু। বয়সে খানিকটা বড়। রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী স্বামী বিবেকানন্দ। ভাবলে বেশ অবাক হতে হয়, খানিকটা আগে-পিছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে হলেও এ চার বাঙালির সবাই জগৎ বিখ্যাত ছিলেন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ১০ বছর আগে ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্ম বিষয়ে আলোড়ন তোলা বক্তব্য দিয়ে বিশ্বখ্যাতি পান স্বামী বিবেকানন্দ। জগদীশচন্দ্র বসু বেতারযন্ত্র বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঊনবিংশ শতাব্দীতেই। এর পরবর্তী সময়ে তাঁর আরও আবিষ্কার বিশ্ববিজ্ঞান মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কাছাকাছি সময়ে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর লেটারপ্রেস ছাপাখানায় বসে রঙিন ছবি মুদ্রণের যুগান্তকারী উন্নতি ঘটিয়ে পাশ্চাত্যজগৎকে তাক লাগিয়ে দেন। ইউরোপের তখনকার মুদ্রণবিষয়ক সব পত্রিকায় তাঁর প্রশংসাসুলভ নিবন্ধ ছাপা হয়ে তাঁকে মুদ্রণজগতে আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী করে। সে এক আশ্চর্য সময় ছিল বটে।
উপেন্দ্রকিশোরকে বলা যায় ভারতবর্ষে শিশুতোষ রচনার পথিকৃৎ। মাত্র ৫২ বছরের জীবনকালে উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিভা বিভিন্ন বিচিত্র বিষয়ে বিকশিত হয়েছে। পুরাণ ও লোককাহিনীকে শিশুদের উপযোগী করে রচনার ক্ষেত্রে এখনো তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। টুনটুনির বই ছাড়াও গল্পমালা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইনসহ’-এর আবেদন এখনো অম্লান। আরও লিখেছেন ছোটদের উপযোগী বিজ্ঞান ও মহাবিশ্ব বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, যার মধ্যে সেকালের কথা আর আকাশের কথা বিজ্ঞান বিষয়ে শিশুতোষ রচনার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
শিশু-কিশোরদের জন্য উপেন্দ্রকিশোরের সবচেয়ে বড় অবদান ছোটদের পত্রিকা সন্দেশ। ১৯১৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে থেমে থেমে হলেও সন্দেশ-এর প্রকাশ এখনো অব্যাহত রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৌতুকরসের সম্মিলনে তিনি কিশোরচিত্তে সঞ্চার করেছেন জ্ঞান-অন্বেষা ও আনন্দ-উপভোগের এক ভিন্নমাত্রার জগৎ। তাঁর সময় সন্দেশ ছিল সারা ভারতবর্ষে শিশুদের জন্য একমাত্র রঙিন পত্রিকা। পরবর্তীকালে সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় আর লীলা মজুমদারের মতো পরিবারের খ্যাতিমানদের পরিচালনা ও সম্পাদনায়, মুদ্রণ ও অলংকরণের সৌকর্যে আর লেখার মান ও বৈচিত্র্যে সন্দেশ হয়ে উঠেছে এক কিংবদন্তি।
এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি একদিকে সাহিত্যচর্চা করেছেন, অন্যদিকে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি সংগীত, অংকন ইত্যাদি চর্চা করেছেন এবং পরিবারের সবাইকে সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে প্রিন্টিং ব্যবসার কাজেও তাদেরকে কাজে লাগিয়েছেন এবং নিজেও কাজ করেছেন। তিনি একাই শিক্ষিত এবং বড় হননি, বরং তার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সেই শিক্ষা সঞ্চার করেছেন। তাই তো তার তৈরি করা শিক্ষার পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
১৯১৫ সালের ২০ডিসেম্বর গিরিডিতে মাত্র ৫২ বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পরলোক গমন করেন। এই সময়ের মধ্যেই তার সৃষ্টি ও কর্ম তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
(তথ্যসূত্রঃ- উপেন্দ্রকিশোর ও মসুয়া রায় পরিবারের গল্পসল্প – হিতেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কথা- সুবিমল রায়, roarmedia, Wikipedia)৷