প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদককবীর চৌধুরী
প্রান্তডেস্ক:বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক ছিলেন কবীর চৌধুরী। তিনি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত। তার ডাকনাম মাণিক। কবীর চৌধুরীর ছোট ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। তিনি জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে লিখতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সাহসী ভূমিকা তাকে বিশেষ গৌরব দান করে ৷কবীর চৌধুরী ১৯৯৮ সালে সরকার কর্তৃক দেশের জাতীয় অধ্যাপক নির্বাচিত হয়েছেন। একজন সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন উদার এবং মুক্তমনা মানুষ ছিলেন তিনি। প্রয়াত এই কর্মী-পুরুষ গত কয়েক দশক ধরে জাতির মননশীলতার বিকাশ এবং কুসংস্কার ও মতান্ধতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছিলেন তার কর্মপ্রচেষ্টা।কবীর চৌধুরী ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার গোপাইরবাগ গ্রামের মুন্সী বাড়ি। পিতা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মা আফিয়া বেগম। তার পুরো নাম আবুল কালাম মোহাম্মদ কবীর। কবীর চৌধুরীর পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় নিজ গৃহেই। পরিবারের সাহচর্যে তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন।
১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি-তে সপ্তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টামিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্সে ১৯৪৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ শ্রেণীতে ১৯৪৪ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেন।
পরে ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তিধারী হিসেবে আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন সাহিত্য সম্পর্কে এবং ১৯৬৩-১৯৬৫ সালে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে।
সরকারি চাকুরি দিয়ে কবীর চৌধুরী কর্মজীবন শুরু করেন। স্বেচ্ছায় সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন৷ ১৯৯৮ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক পদ লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ‘কালচার স্টাডিজ’ কোর্সে গ্রাজ্যুয়েট স্তরে শিক্ষা দান করেছেন৷ চাকরি ও অধ্যাপনা করে তার কর্মজীবন সমাপ্ত হয়। শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য তার অর্থায়নে কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার নামে বাংলা একাডেমি একটি পুরস্কার প্রদান করে।
প্রকাশিত বই-ব্ল্যাক টিউলিপ ১৯৮৯, কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো ১৯৮৯, রূপকথার কাহিনী ১৯৫৯
গবেষণা-প্রবন্ধ: ছয় সঙ্গী ১৯৬৪, শেক্সপীয়র ও গ্লোব থিয়েটার ১৯৮৭, ফরাসী নাটকের কথা ১৯৯০, ইউরোপের দশ নাট্যকার ১৯৮৫, শেক্সপীয়র ও তাঁর মানুষেরা ১৯৮৫, সপ্তরথী ১৯৭০, মার্কিন উপন্যাস ও তার এতিহ্য ১৯৭০
শেক্সপীয়র থেকে ডিলান টমাস ১৯৮১, আমেরিকার সমাজ ও সাহিত্য ১৯৬৮, অভিব্যক্তিবাদী নাটক ১৯৮৭
প্রাচীন ইংরেজি কাব্য সাহিত্য ১৯৮০, আধুনিক মার্কিন সাহিত্য ১৯৮০, এ্যাবসার্ড নাটক ১৯৮৫, মানুষের শিল্পকর্ম ২০০৬, অবিস্মরণীয় বই ১৯৬০।
বাংলা অনুবাদ করেছেন যে বই গুলো-গল্প উপন্যাসে প্রতিকৃতি চিত্র ২০০৭, ওল্ডম্যান এন্ড দি সী।
বেউলফ ১৯৮৫, সমুদ্রের স্বাদ ১৯৭০, দি গ্রেপস অব র্যথ ১৯৮৯, দি গার্ল উইথ এ পার্ল ইয়ার রিং ২০০৭,
অল দি কিংস মেন ১৯৯২, শেখভের গল্প ১৯৬৯, গ্রেট গ্যাটসবি ১৯৭১, রূপান্তর ১৯৯০।
নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তর বইয়ের তালিকায় রয়েছে-ছায়া বাসনা ১৯৬৬, আহবান ১৯৫৬, হেক্টর ১৯৬৯,পাঁচটি একাঙ্কিকা ১৯৬৩, লিসিসস্ট্রাটা ১৯৮৪, সম্রাট জোনস ১৯৬৪, শত্রু ১৯৬২, সেই নিরালা প্রান্তর ১৯৬৬,অমা রজনীর পথে ১৯৬৬, প্রাণের চেয়ে প্রিয় ১৯৭০, শহীদের প্রতীক্ষায় ১৯৫৯, অচেনা ১৯৬৯।
কাব্যনুবাদ বইয়ের তালিকায় রয়েছে-কাহলিল জিবরানের কবিতা ১৯৯২, ভাৎসারোভের কবিতা ১৯৮০, রিস্তো স্নির্নেনস্কির কবিতা ১৯৮৯, সচিত্র প্রেমের কবিতা ২০০০, আধুনিক বুলগেরীয়া কবিতা ১৯৮০, রিস্তো বোতেভর কবিতা ১৯৮৮।
তার বর্ণাঢ্য এই কর্ম জীবনে বহু পুরস্কার তিনি পয়েছেন। এগুলো হলো- ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৪ সালে ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড, ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান গর্ভনর স্বর্ণপদক, ১৯৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার, ১৯৯১ সালে একুশে পদক, ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক,
২০০১ সালে থিয়েটাএর সম্মাননা পদক, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার, ২০০০ সালে রবীন্দ্র শিল্পী সংস্থার সম্মাননা, ১৯৯০ সালে আমরা সূর্যমুখী পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে উইলিয়াম কেরী স্বর্ণপদক, ভারত, ২০১০ সালে গীতাঞ্জলি সম্মাননা পদক লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮২ সালে কাজী মাহবুবউল্লাহ ও বেগম জেবুন্নেসা স্বর্ণপদক, ১৯৯৯ সালে কবি জসীমউদ্দীন পুরস্কার, ২০০৩ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার, ভারতের ট্যাগোর পীস অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৫ সালে অলক্ত স্বর্ণপদক ও সাহিত্য পুরস্কার,
২০০১ সালে বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন পুরস্কার, ২০০৫ সালে নাগরিক নাট্যাঙ্গন সম্মাননা, ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠীর গুনীজন সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী জাতীয় পুরস্কার, ২০০১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ছাত্র সংসদের সম্মাননা, ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সম্মাননা পদক, ১৯৮৯ সালে শেরে বাংলা পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, ১৯৯৭ সালে খালেদ দাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে লোকনাট্যদল স্বর্ণপদক, ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, হাবিব ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৬ সালে বিশ্ব নাটক দিবস সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে শামসুল হক মালিহা খাতুন পুরস্কার।২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর এই দিনে পরলোকগমন করেন তিনি।