পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি কেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চান?

প্রান্তডেস্ক: বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে বাংলাদেশের সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে সৈয়দ আসিফ শাহকার চিঠি লিখেছিলেন আরো প্রায় আট বছর আগে, ২০১৪ সালে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে তিনি কোনো সাড়া পাননি।
এবার তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি লিখেছেন, যেখানে তিনি তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া ও তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
কে এই আসিফ শাহকার? সৈয়দ আসিফ শাহকার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত একজন সুইডিশ নাগরিক, যিনি ২০১৭ সালে সুইডিশ হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছেন। স্টকহোমের বাসিন্দা বিচারপতি শাহকার আত্মীয়-পরিজনদের সাথে দেখা করতে বর্তমানে পাকিস্তানের লাহোরে রয়েছেন। সেখান থেকে টেলিফোনে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, সত্তরের দশকের তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপের এক অংশ যা ন্যাপ মোজাফফর নামে পরিচিত ছিল, তার সাথে যুক্ত ছিলেন। জন্ম ১৯৪৯ সালে পাঞ্জাবের হরপ্পায়। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭১ সালে তিনি পাঞ্জাব স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সুইডেনে চলে যান তিনি। সুইডেনে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং আইন পেশায় যুক্ত হন। এ সময়েই তিনি মানবাধিকার ও গণহত্যা ইস্যুতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন।
তিন সন্তানের জনক বিচারপতি শাহকারের স্ত্রীও একজন সুইডিশ আইনজীবী। বিবিসি-কে শাহকার বলেছেন, সুইডেনেও তার জীবন কঠিন ছিল। তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘পাকিস্তানে কেবল পাকিস্তানিদের ঘৃণার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি। কিন্তু সুইডেনে এসে দেখা গেল, সেখানকার বাংলাদেশি কম্যুনিটির মানুষেরা আমাকে পাকিস্তান এবং পাঞ্জাবের বাসিন্দা হিসেবে ১৯৭১ সালের জন্য ঘৃণা করছে।’
এরপর ২০০০ সালে সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশ মিশনের একজন কর্মকর্তার সাথে তার পরিচয়ের সূত্রে তিনি প্রথমবার সেখানকার বাংলাদেশিদের মুখোমুখি হয়ে তাদের ভুল ধারণা ভেঙে দেয়ার উদ্যোগ নেন। ওই বছরই তিনি বাংলাদেশে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০১ সালে বাংলাদেশে চারদলীয় জোটের অধীনে নতুন সরকার আসার পর তার ওই চেষ্টা থেমে যায়।
বিচারপতি শাহকার বলেছেন, এরপর ২০১০ সালে তিনি নতুন করে সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে যোগাযোগ করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালে তার ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার’ সম্মাননা দেয়। ‘মানসিকভাবে তিনি সবসময় বাংলাদেশের সাথে ‘বিলং’ করেন’ জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারণে তিনি চান বাংলাদেশের নাগরিক হতে এবং তার মৃত্যুর পর এই দেশে সমাহিত হতে।
বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নাগরিক না হলে যেহেতু সেখানে সমাধিস্থ হতে পারবো না। তাই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখেছি।’
তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন,‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ সম্মাননা দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যে বিদেশি স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করেছিল, তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা।’ আপনার কথা আমাকে সরাসরি আপনার কাছে আবেদন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হতে চান এবং এদেশে তিনি বসবাস করতে চান। তার ভাষায়, ‘আমি বাংলাদেশে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে যেতে চাই না। আমি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চাই। কারণ আমি অন্তর থেকে অনুভব করি, পাকিস্তান আমার দেশ না। বাংলাদেশই আমার দেশ।’
ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের সহায়তায় নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ, আমরা একাত্তর এবং প্রজন্ম ৭১ ওই সেমিনার আয়োজন করে। জেনেভার ওই অনুষ্ঠানে ‘আমরা একাত্তর’ সংগঠনের একজন নেতা এবং রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজা জেসমিন তার সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, এতে বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
জেসমিন বিবিসিকে বলেছেন, তখন তাদের সাথে বিচারপতি শাহকার তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন, এবং জানান যে তিনি অনেক বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে চিঠি লিখলেও বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া পাননি। এরপর ‘আমরা একাত্তর’ তার আবেদনটি বাংলাদেশে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়।
জেসমিন বলেছেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বিচারপতি শাহকারের আবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য উপযুক্ত সময় মনে করেছেন তারা, এবং সেজন্যই চলতি সপ্তাহে সেটি তারা করতে চান। সূত্র : বিবিসি এইচএস