দিল্লিতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির একচেটিয়া দাঙ্গা
প্রান্তডেস্ক:স্যাটেলাইট দুনিয়ার বদৌলতে কারও আর এখন জানতে বাকি নেই যে ভারতের রাজধানী দিল্লি এখন জ¦লছে। উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা জাফরাবাদ, মৌজপুর, জোহরাপুরী, ভজনপুরা, গোকলপুরী সর্বত্রই এখন অগ্নিগর্ভ অবস্থা। বলা হচ্ছে যে, সিএএবিরোধীদের সঙ্গে সমর্থকদের গোষ্ঠী সংঘর্ষের কারণেই দিল্লি পরিস্থিতি এরকম উদ্বেগজনক। সরকারি হিসাবেই ইতিমধ্যে সেখানে মারা গেছেন অন্তত ‘চৌত্রিশ জন’। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা আরও বাড়বে। আহত হয়েছেন কয়েকশত। এ ভয়ংকর পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। ধীরে ধীরে সুচতুর কৌশলে নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের ওপর ঘৃণা ছড়িয়ে পরিসর তৈরি করা হয়েছে। ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই। গোটা দুনিয়ার কাছে এখন স্পষ্ট যে, দিল্লিতে কোনো দাঙ্গা হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা নিছক জেনোসাইড বা গণহত্যা।
আমি জানি, আপনারাও অনেকেই এখন জানতে চাইছেন দিল্লি জেনোসাইডের জীবন্ত বর্ণনা। কীভাবে অনেকে মিলে ঘিরে ফেলে একজনকে লাঠি, রড, হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক মারছে কিংবা মহম্মদ সঈদ সলমনির সেই কাহিনীও সামনে আসছে। দুপুরে দুধ কিনতে বেরিয়ে সলমনি খবর পেলেন তার বাড়ি জ¦লছে। প্রায় শ’খানেক লোক সশস্ত্র হামলায় তছনছ করছে তাদের বাসা, মহল্লা। নিচের দর্জির দোকান দুটি দাউ দাউ করে জ¦লছে। ছেলে ও পরিবারের সবাই কোনোরকমে ছাদে উঠে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে রয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা পর ঘরে ফিরে হাহাকার করে ওঠেন সলমনি। পরিবারের অন্যরা প্রাণে বাঁচলেও তার পঁচাশি বছরের বুড়ি মা আকবরি পালাতে না পেরে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। পূর্বদিল্লির লক্ষ্মীনগরে সন্ধ্যা হতে না হতেই মিছিল বেরিয়েছে। সে মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছে ‘দেশকে হত্যারোঁ কো, গোলি মারো শালাকো।’ বিজেপি বিধায়ক অভয় বার্মার নেতৃত্বে মিছিল স্লোগান তুলেছে ‘যো হিন্দু হিতকি বাত করেগা, ওহি দেশমে রাজ করেগা।’ এই ঘন অন্ধকার নিয়ে পাতার পরে পাতা আমি লিখে যেতে পারি। লিখে যেতে পারি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে কীভাবে সুকৌশলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কংগ্রেসের জামানায় তবু কিছু রাখঢাক ছিল। এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শাসনে সবটুকু শালীনতা, মুখোশ সরে গিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্রের বেআব্রু পোশাক পুরোপুরি খুলে পড়েছে। এই কদর্য নগ্ন চেহারা আমার কাছে নতুন নয়। দিল্লির ছবি দেখতে দেখতে কখন কীভাবে যেন সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকে ২০০২ সালে গণহত্যার গুজরাটে ফিরে গেছিলাম। টুকরো টুকরো কত ছবি। ছবি কি শুধুই ছবি! এক একটা দৃশ্য যেন বুক মোচড়ানো কান্না। তখন বয়েস অনেক কম। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে, ক্যামেরা হাতে ছোট্ট ইউনিট নিয়ে চলে গিয়েছিলাম বিধ্বস্ত গুজরাটে। কখনো ভুলতে পারি না নারোদা পাতিয়ার মহল্লায় লুকিয়ে ঘুরেফিরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। একটা টিয়াপাখি খাঁচাবন্দি হয়ে একমনে অস্থির গলায় হারিয়ে যাওয়া মালিককে খুঁজছে, আগুনে ঝলসানো এক বাড়ির মেঝেতে অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে শিশুর আধপোড়া স্কুল ড্রেস। এখনো ঘুমের মধ্যে তাড়া করে জাভেদের ক্লান্ত বিষাদে মাখা মুখ। কতটুকু ছেলে জাভেদ! খুব বেশি হলে দশ-এগারো বছর ওর বয়স। চোখের সামনে নিজের পরিবারের দশজনকে খুন হতে দেখেছে। শাহআলম দরগা। যেখানে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার মুসলিম পরিবার। কয়েক দিন ধরে সেখানে যেতে যেতে অনেকের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছে। এক দিন সকাল সকাল সেখানে গিয়ে দেখি একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে মায়ের কোলে বসে সমানে কাঁদছে। বিরক্ত মা তাকে বকে যাচ্ছে। জানতে চাইলাম ‘কী হয়েছে!’ অল্পবয়সী মা বলল, ‘ও সকাল থেকে বায়না ধরেছে আব্বার কাছে যাওয়ার। কী করে ওকে বোঝাই যে ওর আব্বা বেঁচে নেই।’ বাড়িও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বজরংদলের গু-ারা। আহমেদাবাদের রাস্তায় মিশে গেছে সম্প্রীতির মুখ বালি গুজরাতির মাজার। এই সম্প্রীতি শব্দটাও কেমন যেন ইদানীং বিদ্পের মতো শোনায়। ২০০০ সাল থেকে শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছি। নেলি, মুজাফফরপুর, ভাওনা আর আজকের এই সন্ত্রাসবিদ্ধ দিল্লি। এক-একটা ঘটনা ঘটে আর আমরা সম্প্রীতির মিছিল করি। মানববন্ধনের ডাক দিই। সারা বছর প্রতিবেশীর দিকে ফিরেও তাকাই না, ভালোবেসে কাছে ডাকা তো দূর-অস্ত। এই বিপুল অপরিচয়ের পথ ধরেই জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িকতা। যারা দাঙ্গা করে, এবারও যাদের মুখ দাঙ্গাবাজ বলে টিভিতে দেখছি একসময় তাদের জন্যও এক গভীর ব্যথা অনুভব করছি। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন কতটুকু তাদের বয়স। চৌদ্দ, পনেরো বড়জোর ষোলো-সতেরো। সে মুখে অভাবের, যন্ত্রণার, অশিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। চাকরি নেই। ব্যবসা করে খাওয়ার মুরোদ নেই। লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার কোনো যোগ্যতা নেই। কেউ কোনো দিন মিষ্টি করে কথা বলেছে বলেও মনে হয় না। সমাজে বাতিল হওয়া এই কিশোর-তরুণরাই আজ দাঙ্গার মুখ। এদের কাঁধে বন্দুক রেখেই দেশের গণ্যমান্য মাতব্বররা ক্ষমতায় আসেন। মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যান। দেশ-বিদেশের উজ্জ্বল আলোয় তাদের মুখ যত উদ্ভাসিত হয় ততই অন্ধকারে তলিয়ে যায় দাঙ্গাকারী তরুণরা। একদা জার্মানির দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছিল ‘হিটলার তুমি আমাদের রুটি দাও না হলে আমরা আবার কমিউনিস্ট হয়ে যাব।’ এও যেন তাই। মোদি তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন নতুন এক ঝলমলে ভারতের। তাই অন্ধভাবে বিশ্বাস করে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে সংঘাতের, রক্তের নেশায়।
তবু আজ শুধুই অন্ধকারের গল্প বলব না। বলব জানা না জানা অসংখ্য কাহিনী। যা রাতের অন্ধকারেও আলো দেয়। বলব সেসব দলিত হিন্দুর কথা যারা দিল্লির উন্মত্ত গেরুয়া বাহিনীর হামলার মুখে দাঁড়িয়ে মুসলিম বাচ্চাদের বাঁচিয়েছে। সেই শিখদের কথা যারা একাধিক গুরুদুয়ারা খুলে দিয়েছে বিপন্ন মানবতাকে আগলে রাখতে। হিন্দু পরিবারের অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাশে থেকেছেন পড়শি মুসলমান পরিবারের। তাই এটা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রদায়ের দাঙ্গা নয়। বরং বলা ভালো দিল্লিতে যা হচ্ছে সেটা মানবতার বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির একচেটিয়া দাঙ্গা। এই দাঙ্গার আগুনের দিকে তাকাতে তাকাতে কখন যেন আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা মনে পড়ে যায়। খুলনা ছিল আমার মামা বাড়ি। দেশভাগের পর নিজেদের তথাকথিত আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে ওপার থেকে চলে আসতে হয়েছিল মা-মাসি-দিদিমাকে। যতদিন মা বেঁচে ছিলেন ততদিন অজস্রবার শোনাতেন তার সামসুল চাচার কথা। তিনি কোলেপিঠে মানুষ করেছিলেন
মা-মাসিদের। স্বাভাবিকভাবেই তিনি চাননি মা-দিদিমা এপারে চলে যান। যতদূর যাওয়া যায় ততদূর তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে মায়েদের সঙ্গে ছিলেন। তার হাত নেড়ে চলে যাওয়া মা কখনো ভুলতে পারেননি। আমার দিদিমা বেঁচে থাকতে একটি মিষ্টি কখনো মুখে তোলেননি। হাজার জোরাজুরি করলে শুধু বলতেন ‘ও মিষ্টি প্রাণ ধরে আমি মুখে দিতে পারব না। তোমরা আমাকে জোর করো না।’ দিদিমা চলে যাওয়ার অনেক দিন বাদে জানতে পেরেছিলাম না খাওয়ার কারণটা। দিদিমা ছেলের মতো ভালোবাসতেন মামার বন্ধু আনোয়ারকে। ১৯৫০ সালে রাজশাহীতে খাপড়া ওয়ার্ডের ভেতরে পুলিশের গুলিতে পুত্রসম আনোয়ার হোসেন শহীদ হওয়ার পর আর কোনোদিনই তার পছন্দের মিষ্টি ছুঁয়েও দেখেননি ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র অন্যতম নেত্রী আমার দিদিমা, তিরিশের দশকের কবি মনোরমা দেবী সরস্বতী।
মিছিল-মিটিং-সেমিনার, মানববন্ধনেই শুধু সম্প্রীতি রক্ষা করা যায় না। কীভাবে তা রক্ষা পায় সেটা পরিস্থিতির মধ্য থেকে আমরা অনেক সময় শিখি। দিল্লির আগুন নিশ্চয়ই আজ না হয় কাল নিভে যাবে। কিন্তু বিষাক্ত ঘায়ের মতো ওই দগদগে ক্ষত যতদিন মনের মধ্যে থেকে যাবে ততদিন সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি থেকে আমাদের রেহাই নেই। মনের মধ্যে বিষ ঢোকানো হয়েছে দিনের পর দিন। আমাদের
সাহিত্য-নাটকে-সিনেমায়-পাঠ্যবইয়ে পড়শি জনগোষ্ঠী নিয়ে বছরের পর বছর মিথ্যে কথা বলা হয়েছে। এখনো সময় আছে সত্যিকার ভালোবেসে পড়শির হাত ধরার। দাঙ্গা বন্ধ হয় কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থেকে যায়। আপনার প্রতিবেশীর সঙ্গে মিশে দেখুন সে আদৌ ততটা খারাপ নন। পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে তৈরি হোক মানববন্ধন। গড়ে উঠুক জনগণের সংহতি। না হলে আজ ভারতের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, কাল প্রতিবেশীদের আকাশও হয়তো ঝলমলে থাকবে না।
লেখক:ভারতের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা(সৌজন্যে:দেশরূপান্তর)