মার্কিন সমাজ কি স্যান্ডার্সকে গ্রহণে প্রস্তুত
আহমদ রফিক:মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক ঘরানার পরাশক্তি দেশ, এ বিষয়ে সম্ভবত কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। গত বিশ^যুদ্ধ অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আবির্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার নানা ঘটনায় এই প্রমাণ পরিচয়ই বারবার দিচ্ছে। কখনো দেশ-বিভাজনে, কখনো বিভাজিত দেশ একত্রকরণে আবার প্রায়শ বিরোধী মতের দেশের ওপর আক্রমণে তারা তাদের প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ তুলে ধরেছে। সে শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্য অস্ত্রশক্তির। তাদের ‘নয়া বিশ্ব বিধান’ এমন ধারণাই দিচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থশক্তি ও অস্ত্রশক্তির জোরে বিশ্ব শাসনের যোগ্যতা রাখে। তাই একের পর এক বিরোধীপক্ষীয় রাষ্ট্রগুলোর শাসকশ্রেণির পরিবর্তন ঘটিয়েছে তারা, কখনো প্রত্যক্ষ আক্রমণে, কখনো সে দেশের অভ্যন্তরে কূটকৌশলে বিদ্রোহ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করে লক্ষ্য অর্জন করেছে।
প্রত্যক্ষ আক্রমণের বড় উদাহরণ বুশ-ব্লেয়ারের পরিকল্পনায় মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ। পরিণামে দেশটিতে স্থায়ী অশান্তি, রক্তপাত এবং বিচ্ছিন্নতার সংঘাত ও সহিংসতা। দ্বিতীয় উদাহরণ লিবিয়া সেখানকার কথিত লৌহমানব-শাসক গাদ্দাফি হত্যা এবং দেশটিতে দীর্ঘস্থায়ী চরম বিশৃঙ্খলা রাজনৈতিক ও সামাজিক। সিরিয়া নিয়ে ঘটনা ভিন্ন নয়। তবে যে কারণেই হোক, রুশশাসক পুতিন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারের পক্ষে সশস্ত্র সাহায্যে এগিয়ে আসায় সিরিয়ার শাসকের পতন বিলম্বিত, পরিণামে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র অর্জন করেছে এবং যত বিপর্যয় সাধারণ মানুষের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ও মৃত্যু। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নজর পড়েছে সর্বশেষ মার্কিন বিরোধিতার বড় ঘাঁটি ইরানের দিকে। বিনা প্ররোচনায় সে দেশের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর সামরিক ব্যক্তিত্ব কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করা হয়েছে ট্রাম্পের গোপন নির্দেশে। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা যে, এ রাজনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী বিশ^ জাতিসংঘে প্রতিবাদের ঝড় তোলেনি, ঘাতকের বিচার দাবি করেনি আন্তর্জাতিক আদালতে।
এ তো গেল যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ-নীতির চরিত্র, যা কথিত প্রেসিডেন্ট চরিত্রনির্ভর হলেও কোনো উদারনৈতিক প্রেসিডেন্টের সাধ্য নেই ওয়ালস্ট্রিটের যুদ্ধবাদী লবিকে অগ্রাহ্য করে মানবিক উদাহরণ তৈরি করে। কোনো দেশের প্রতি আরোপিত অবরোধ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে শক্তিধর ইহুদি-লবি চরম রক্ষণশীল চরিত্রের জিয়োনিস্ট নির্মমতা হিটলারি নিষ্ঠুরতার তুল্যমূল্য। তাই ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ কী বিল ক্লিনটন, কী বারাক ওবামা। ফিলিস্তিনি আরবদের উদ্বাস্তুদশা কিংবদিন্তসুলভ জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতির আমল থেকে ইয়াসির আরাফাত হয়ে বর্তমানকালেও প্রায় একই ধরনের নামকাওয়াস্তে আবাসন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র বহুত দূর অস্ত। বরং ট্রাম্পের সমর্থনে জেরুজালেম ফিলিস্তিনিদের হাতছাড়া হয়ে গেল। কী ট্র্যাজেডি একটি জাতিগোষ্ঠীর!
দুই.
এ আলোচনা দীর্ঘ করার সুযোগ নেই। বরং দেশটির ঘরোয়া আর্থসামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে দু-চার কথা বলা দরকার একালের তরুণ প্রজন্মের মননে কিছু রেখাপাতের প্রয়োজনে। একটি মহাদেশের সুযোগ-সুবিধা ও সমৃদ্ধি হাতের মুঠোয় থাকার কারণে বিত্তবান শ্রেণির বাইরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত শ্রেণি সে সুযোগ-সুবিধা ও ব্যক্তিক অধিকার ভোগ করে থাকে তাতেই তারা তুষ্ট, রাজনৈতিক অন্যায়-অনাচার নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে ইচ্ছুক নয়, দুর্মূল্য শিক্ষা, দুর্মূল্য চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার মতো অসাম্য সত্ত্বেও। আর একটি বিষয় এখানকার রাজনীতিকরা দীর্ঘকালীন অপপ্রচারে সমাজের মাথায় গেঁথে দিতে পেরেছে যে, তা হলো সমাজতন্ত্র নামক জুজুর ভয় সমাজতন্ত্র তাদের সব গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেবে, এমনকি ধর্মাচারের অধিকারও। তাই ওই ‘পাপ’ থেকে শত হাত দূরে থাকো। আশ্চর্য, মার্কিনি সমাজের মেধা ও মনন যেমন বিরাজমান সামাজিক বৈষম্য ও বর্ণবাদ নিয়ে যুক্তিবাদের আশ্রয় নেয়নি, তেমনি রাজনৈতিক অপপ্রচারের দিকগুলো নিয়ে স্বচ্ছ মনে ভেবে দেখেনি। জীবনযাত্রার চলমান স্রোতে গা ভাসিয়ে আপাত-বিনোদনের ভোগবাদে ভেসে চলাকেই জীবনের সার্থকতা রূপে ধরে নিয়েছে। বৌদ্ধিক চিন্তা তাদের সামান্যই আকর্ষণ করেছে। ব্যতিক্রম সামান্য।
আমার এক নিউ ইয়র্ক প্রবাসী চিকিৎসক বন্ধু সরস ভাষায় বলেছিল ‘শ্রেণি-বিশেষের জন্য ওখানে জীবন স্বাচ্ছন্দ্য মূল কথা হলো, পরিশ্রম করো, ডলার কামাও, জীবনকে পছন্দমতো ধারায় ভাসিয়ে দাও, প্রগতি রাজনীতি নিয়ে ভেবো না, জীবন স্রোত অনুকূল ধারায় বয়ে যাবে।’ জানি না, মার্কিনি সাধারণ সমাজ সম্পর্কে এ মূল্যায়ন কতটা সঠিক? তবু অলস সময়ের ধারায় বর্ণবাদী পাপ ও উগ্র শে^তাঙ্গ জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতার মধ্যেও কিছু ভিন্ন বোধের প্রকাশ ঘটা হয়তো সমাজ বিজ্ঞানেরই নিয়মে। তা না হলে কৃষ্ণাঙ্গ বংশোদ্ভূত বারাক ওবামা দু-দুবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন কীভাবে? বর্ণবাদী আমেরিকায় এ তো অবিশ্বাস্য ঘটনা, যেখানে এখনো অতি আলোর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ঘেটুর অন্ধকার বিরাজ করছে।
তবু নিগূঢ় সত্যটা, মার্কিনি রাজনীতির বাস্তব সত্যটা থেকেই গেছে। ওবামা কিছু সংস্কারমূলক সমাজহিতের কাজ করার চেষ্টা করলেও তার কাছ থেকে গণতন্ত্রী মানুষের প্রত্যাশা মেটেনি। ওয়ালস্ট্রিট ও পেন্টাগনের শৃঙ্খলভাঙা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি, হওয়ার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজে এখনো তৈরি হয়নি। এর জন্য বেশ কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে।
তবে সম্ভাবনার বিচ্ছিন্ন স্ফুলিঙ্গ যে বিরাজ করছে, তার অন্তত একটি প্রমাণ তো বছর কয় আগে যুবকদের ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন’, যা প্রাজ্ঞ, সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে পড়ার পরও ব্যর্থতায় পর্যবসিত। কিন্তু এর বীজতলা তাৎপর্যহীন নয়। এ আন্দোলনের একটি তথ্য-জরিপ করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। আর তা হলো, এ আন্দোলনে সক্রিয় যুবকদের কত শতাংশ খাস শ্বেতাঙ্গ-আমেরিকান, কতটা অভিবাসী বা বিদেশি বংশজাত ও ভিন্ন বর্ণের। এ তথ্যাদি জানা থাকলে কিছু রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ মেলানো সহজ হতো। তবু উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও যুদ্ধবাজ ট্রাম্পের বিজয় কিছু মোটা সামাজিক সত্যের প্রকাশ ঘটালেও এর মধ্যেই বার্নি স্যান্ডার্সদের রাজনৈতিক আবির্ভাব মোটেই তাৎপর্যহীন নয়। অখ্যাত ভারমন্ট অঙ্গরাজ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ নিউ হ্যাম্পশায়ারের সান্ডার্সের নিজ দলের মনোনয়নে বিজয় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারও বিচারে অপ্রত্যাশিত হলেও।
তিন.
বার্নি স্যান্ডার্স সিনেটের, রাজনৈতিক পরিচয়ে তিনি সমাজতন্ত্রী (তবে উগ্র নন), তার রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মসূচি স্পষ্টভাবেই যেমন পরিচয় দেয়, তা সত্ত্বেও সিনেটর, তা সত্ত্বেও প্রাইমারি নির্বাচনে বিজয়। প্রশ্ন, কারা তার পক্ষের ভোটার পূর্বোক্ত প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে? তাহলে কি মার্কিনি সমাজের পূর্বোক্ত শ্রেণিতে নীরব পরিবর্তন ঘটে চলেছে দুঃশাসনের প্রতিক্রিয়ায়? স্যান্ডার্স সম্পর্কে আরও দু-চারটে কথা বলা ও জানা দরকার। যেমন তিনি ইয়েমেনে সংঘটিত নৃশংসতায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতার বিরোধী এবং তা বন্ধ করতে তৎপর, তিনি ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের জবরদস্তিরতদের ঘোরবিরোধী। সর্বোপরি তার সমাজতন্ত্রী ধারার সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে খোদ ডেমোক্র্যাট দলেও রয়েছে ভিন্নমত। স্বভাবতই খাস ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের অনেকে হয়তো জো বাইডেনের জয় কামনা করবেন। কারণ ডেমোক্র্যাটরা নামে যাই হোক, রাজনৈতিক চরিত্র বিচারে কিছু ব্যতিক্রমবাদে সমাজতন্ত্রী ধারা থেকে অনেক দূরে। এই অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব ও দুর্বলতা নিয়ে তারা উগ্র জাতীয়তাবাদী, যুদ্ধবাজ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয়ের স্বপ্ন কীভাবে দেখবেন সেটাও এক বড় প্রশ্ন। রিপাবলিকান মহলের ট্রাম্পবিরোধিতা যে এখন উধাও, অভিশংসনের ফলাফল তার প্রমাণ। সবকিছু মিলিয়ে এ মুহূর্তে এমন ধারণাই জোরালো যে, আগামী নির্বাচনের ভোটার-আবহ ট্রাম্পের পক্ষে, যদিও সতর্কবাণী নেহাত কম নয়।
এ প্রসঙ্গে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার সময় এখনো অনেক দূর। দলীয় মনোনয়ন-নির্বাচন পর্বে শেষ পরিণামের কিছু আভাস ইঙ্গিত মিলতে পারে। আর নির্বাচনের ফলাফল তো অনেকটা জুয়া খেলার মতোই, শেষ কথা বলা বড় কঠিন। তবু ঘটনা মনোনয়ন-সংক্রান্ত হলেও স্যান্ডার্সকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট কৌতূহল লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি শিরোনাম : ‘স্যান্ডার্স কি পারবেন ডেমোক্রেটিক সিনেট গড়তে?’ অন্যটি ‘স্যান্ডার্স আগামী প্রেসিডেন্ট?’ না, শেষ কথা বলার সময় যেমন এখনো আসেনি, তেমনি ব্যক্তিগত সক্ষমতা সত্ত্বেও সান্ডার্সের সমস্যা একাধিক, যে কথা এর আগে উল্লিখিত, তদুপরি তার বয়সটাও বিবেচ্য বিষয়। সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয় মার্কিন সমাজ কি সান্ডার্সের মতো ব্যক্তিত্বকে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা পুরোপুরি অর্জন করেছে, নাকি সেজন্য আরও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে?
লেখক:ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক(:সৌজন্য:দেশরূপান্তর)