কৃতিত্বটা এককভাবে পুঁজিবাদেরই
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :দেশজুড়ে নানা অপ্রত্যাশিত অঘটন ঘটেই চলেছে। যদি প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায় তবে প্রতিকারের কোনো উপায়ই থাকবে না। কিন্তু প্রতিরোধ তো নেই। পাকিস্তান আমলে ছিল, এখন নেই। কারণ কী? মূল কারণটা কিন্তু মোটেই অস্পষ্ট নয়। সেটা হলো এই যে, পাকিস্তান আমলে যারা রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করত তাদেরই একাংশ এখন রাষ্ট্রের শাসক হয়ে বসে গেছে, আর যারা ওই সুযোগটা এখনো পায়নি তারাও আশায় আছে, কেউ কেউ উচ্ছিষ্টের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। সহজ ও দৃষ্টিগ্রাহ্য একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি বইয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে একটা বড় ভূমিকা ছিল মস্কোপন্থি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের, এবং ছাত্র-সংগঠনটির তখনকার সভাপতি ছিলেন নূরুল ইসলাম নাহিদ। আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতেই তাকে দেখা যেত। পরে তিনি দীর্ঘমেয়াদে ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী, এবং তার মন্ত্রণালয়ই পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতিকরণের জন্য দায়ী। তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। যেন অসহায়।
ছাত্র ইউনিয়ন ততদিনে, আসলে ওই আন্দোলনের আগেই দুই ভাগ হয়ে গেছে; এক ভাগ মস্কোপন্থি অন্যভাগ চীনপন্থি। মস্কোপন্থিদের ডাক নাম ছিল ‘মতিয়া গ্রুপ’, পিকিংপন্থিদের ডাক নাম ‘মেনন গ্রুপ’। মস্কোপন্থি মতিয়া চৌধুরী ও পিকিংপন্থি রাশেদ খান মেননের এখন কিন্তু বিরোধ তো পরের কথা, কোনো দূরত্বই নেই। তারা একত্র হয়ে গেছেন, দুজনেই তারা সরকারি দলের মন্ত্রী ছিলেন, এখন সাংসদ। পাকিস্তান আমলে এমন অত্যাশ্চর্য ঐক্য সম্ভব বলে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য ছিল। এখন, সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাভূত-করে-প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে সেটাই ঘটেছে। কৃতিত্বটা কিন্তু তাদের নিজেদের নয়, আওয়ামী লীগেরও নয়, সব কৃতিত্ব ও প্রশংসা একজনেরই প্রাপ্য, তার নাম পুঁজিবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফলে সহজলভ্য সুযোগ-সুবিধা আরও অনেকের মতো এদেরও পুঁজিবাদী করে ছেড়েছে। পুঁজিবাদ তো নাচাবেই, নাচাচ্ছেও। যারা নাচতে চান তারা নাচছেন। জাতীয়তাবাদীরা সবসময়েই পুঁজিবাদী ছিলেন, একদা-সমাজতন্ত্রীদেরও অনেকেই ওই পথ ধরেছেন। তাহলে? কে করবে আন্দোলন? নৃত্যব্যস্তদের পক্ষে কি আন্দোলন করা সম্ভব?
দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন সব কর্তৃত্ব ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত জাতীয়তাবাদীদের হাতে। পুঁজিবাদবিরোধী বামপন্থিরা তখন মোটামুটি ছত্রভঙ্গ দশায়। পিকিংপন্থিরা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, তাদের অনেকেই রক্ষীবাহিনীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন, প্রাণও দিয়েছেন, কেউ চলে গেছেন ভূগর্তে, কেউ নিষ্ক্রিয়। সুযোগ ছিল মস্কোপন্থিদের পক্ষে উঠে দাঁড়ানোর। তারা আক্রান্ত হননি। তারা প্রকাশ্যে ছিলেন। বিভিন্ন ফ্রন্টসহ তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থক সরকারি দলের তুলনায় কম ছিল না, বেশিই ছিল। তারা যদি একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নিতেন তাহলে রাষ্ট্র হয়তো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পথে এগোতো। না, তেমন কোনো অবস্থান তারা নেননি। তারা যা করলেন তা হলো শাসক দলের সঙ্গে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন। ফলে সরকারি দলের বিকল্প কোনো দল আর রইল না। মানুষ কিন্তু বিকল্প চাচ্ছিল। সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরবার, সরকার যাতে জনবিরোধী হওয়ার পথে অগ্রসর না হয় সেজন্য একটি রাজনৈতিক শক্তির চাপ সৃষ্টির প্রত্যাশা ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছিল। ওই সুযোগে আবির্ভাব ঘটল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর। জাসদের নেতারা আওয়ামী লীগের ভেতরেই ছিলেন, তারা মোটেই বিপ্লবী ছিলেন না, ছিলেন বঞ্চিত। বঞ্চিত হয়েই তারা বেরিয়ে এলেন। বঞ্চনা বড় কঠিন দায়। নেতারা সবাই ছিলেন মুজিব বাহিনীর সংগঠক। তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল “বিশ্বে এলো নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ” আওয়াজে স্বর মেলানো। সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে তারা পাল্টা আওয়াজ খুঁজলেন। পেয়েও গেলেন। হাতের কাছেই সেটা; পড়েছিল, আওয়াজটা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের। এই আওয়াজ প্রকাশ্যে দেওয়ার মতো লোক তখন ছিল না। ততদিনে মস্কো নিজেই পুঁজিবাদকে ধ্বংস করার অঙ্গীকারের লাইন থেকে বিলক্ষণ সরে দাঁড়িয়েছে; বলতে শুরু করেছে অপুঁজিবাদী উন্নয়নের কথা। অর্থনৈতিক উন্নয়নই তখন লক্ষ্য, বিপ্লব নয়। বাংলাদেশের মস্কোপন্থিরাও আওয়ামী লীগের ভেতরে জাতীয় বুর্জোয়া পাওয়া যাবে বলে আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছেন, এবং আওয়ামী লীগের হাত আঁকড়ে ধরতে সচেষ্ট রয়েছেন। ওই শূন্যতায় জাসদের পক্ষে তাই সম্ভব হলো প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণের। যে নেতারা এক সময়ে সমাজতন্ত্রীদের সর্বাধিক ঘৃণ্য শত্রু ভাবতেন, যাদের জ্ঞান-ধ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বামপন্থার বিনাশ সাধন, তারাই এখন সমাজতন্ত্রের ও শ্রেণিসংগ্রামের এবং সামাজিক বিপ্লবের আওয়াজ দিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলা শুরু করলেন। সদ্যস্বাধীন দেশের তরুণরা ঠিক ওই আওয়াজের প্রতীক্ষাতেই ছিল। তারা ভাবল পাওয়া গেছে; এতদিনে সাচ্চা বিপ্লবীদের অভ্যুদয় ঘটেছে। দলে দলে, শতে শতে, হাজারে হাজারে, তারা ছুটে এলো। নকল লাল ঝান্ডা তুলে জাসদের নেতারা একটি দুটি নয়, তিন তিনটি পাখি একসঙ্গে সাবাড় করে দেওয়ার সুযোগ পেলেন। প্রথমত, বড় নেতা হলেন। দ্বিতীয়ত, যে তরুণরা বামপন্থি হওয়ার জন্য অত্যন্ত উন্মুখ ছিল তাদের একটা অংশকে বিপ্লববিরোধী জালের ভেতর আটকে ফেললেন।
তৃতীয়ত, সরকারের কাছেও ইশারা তুলে রাখলেন যে এই তরুণরাই ভবিষ্যতের বিপ্লবী শক্তি, এদের মোকাবিলা করতে পারলে দেশে বিপ্লব-টিপ্লব ঘটবে না, এবং পুঁজিবাদী উন্নতির পথটা নির্বিঘ্ন হবে।
জাসদের মূল নেতাদের হয়তো আশা ছিল যে, শক্তির একটা প্রদর্শনী খাড়া করতে পারলে বঙ্গবন্ধু তাদের যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করবেন, এবং আদর করে নিজের কাছে ডেকে নেবেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। অকল্পনীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং সপরিবারে নিহত হলেন। এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবেই দেখা গেল যে ওই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির পরে জাসদের রাজনীতিও গতিপথ হারিয়ে বিভিন্ন ধারা-উপধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ছে। যেন তাদের সামনে দৃশ্যমান কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যেন পথ-হারা একদল পথিক।
জাসদের নেতারা যে নিজেদের জাতীয় সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় দিতেন সেটা যে তারা হিটলারের নাৎসি দলের নামের কথা মনে রেখে করতেন তা হয় তো নয়, কিন্তু তারা যে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের বাঘ ও হরিণকে একঘাটে এনে মেলাতে চেয়েছিলেন এটা তো ওই নাম-রাখা থেকেই বোঝা যায়। এটাও নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে ভেতরে ভেতরে তারা পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীই রয়ে গেছেন; কাজের সুবিধার জন্য সমাজতন্ত্রের পোশাকটা গায়ে চাপিয়েছেন। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় অনেক কিছুর মধ্যে একটি ছিল ‘মশাল মিছিলে’র অত্যন্ত উদ্দীপক পদচারণা। জাসদপন্থিরা সেই মশালটাও ছিনিয়ে নিলেন, মশালকে করলেন তারা দলীয় প্রতীক। বামপন্থিদের শূন্যস্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার তীব্র তাড়নায় ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে সেই আওয়াজটাও তারা তুলেছিলেন, আওয়ামী শাসনে হতাশাগ্রস্ত ও বীতশ্রদ্ধ মানুষ যেটা শুনতে চাইছিল; ‘মুজিব মণি মোজাফফর, বাংলার মীরজাফর।’ মণি হচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মণি সিংহ, মোজাফফর মস্কোপন্থি ন্যাপের প্রধান মোজাফফর আহমদ। পরে অবশ্য শেখ মুজিবের অভাবে তারা কার বিরোধিতা করে জনপ্রিয়তা রক্ষা ও শক্তি প্রদর্শন করবেন সেটা বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এদিক সেদিক ছুটেছেন। একটি ধারা অবশ্য বেরিয়ে গিয়েছিল; যেটি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের সরাসরি সমাজতন্ত্রী বলেছে, এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। চালিকাশক্তিও ছিলেন বামপন্থিরাই, বিশেষভাবে বামপন্থি ছাত্ররা। ছাত্রলীগের তুলনায় ছাত্র ইউনিয়নের দুটি ধারাই তখন অধিক শক্তিশালী। স্বাধীনতার পরেও বামপন্থার দিকেই স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল ছাত্রদের। ১৯৭২-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের নির্বাচনে (ডাকসু) মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নই জয়ী হয়েছে। কিন্তু পরে তারা তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান আর ধরে রাখতে পারেনি; কারণ মূল সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি দ্রুতবেগে হাত মিলিয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ওদিকে সরকারবিরোধী আওয়াজ তুলে জাসদপন্থি ছাত্রলীগ বের হয়ে এসেছে প্রবল বিক্রমে। ছাত্ররা আকৃষ্ট হয়েছে তাদের প্রতি। ভেবেছে এরাই ভরসা। ফলে দেখা গেল পরের বছরই, ডাকসুর নির্বাচনেই মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন একাকী দাঁড়াবে এমন ভরসা পাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে সেই লক্ষ্য প্রতিষ্ঠা থেকেই যে ছাত্রলীগকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে সেই ছাত্রলীগের সঙ্গেই ঐক্যজোট গড়ল। কিন্তু এই জোট ছাত্রসমাজের সমর্থন পেল না। নির্বাচনে হেরে যাচ্ছে টের পেয়ে ছাত্রলীগের নেতারা ব্যালটবাক্স অপহরণ করে। ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থন দেয়। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ প্যানেলে ভিপি’র পদপ্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল আলম লেনিন, সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ইসমত কাদির গামা। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে গামা আওয়ামী ধারাতেই রয়ে গেছেন, যেমনটা তার থাকবার কথা; কিন্তু লেনিনও চলে গেছেন আওয়ামী লীগে, ঠিক যেভাবে অনলবর্ষী মতিয়া চৌধুরী মোজাফফর ন্যাপের নেতৃত্ব ত্যাগ করে যুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগে; এবং মন্ত্রী হয়েছেন, প্রত্যাশিত রূপে। পুঁজিবাদের টান এমনই দুর্বার।
পুঁজিবাদের তৎপরতা এগিয়ে যাচ্ছিল অপ্রতিহত গতিতে। প্রথা ছিল যে, একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের শুরু হবে প্রভাতফেরি দিয়ে। ১৯৭০ সালে, অর্থাৎ ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের পরের বছরেই, দেখা গেল রীতিতে পরিবর্তন এসেছে; কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দিচ্ছে রাত বারোটা এক মিনিটে। এটি পুঁজিবাদী বিশ্বের সাংস্কৃতিক রীতি। তাদের দিন শুরু হয় মধ্যরাতে; বাঙালির দিন শুরু প্রত্যুষে; তাদের নিউ ইয়ার্স ডে শুরু হয় রাত বারোটায়, বাঙালির নববর্ষের শুরু সূর্যোদয়ে। বোঝা গেছে থার্টি-ফার্স্ট নাইট এগিয়ে আসছে, পুঁজিবাদ পা রাখছে সংস্কৃতির এলাকাতে, হস্তক্ষেপ ঘটাচ্ছে নিঃশব্দে। মধ্যরাতে একুশে ফেব্রুয়ারি শুরু করার ‘আধুনিক’ রেওয়াজটা আর বদলায়নি, কায়েমি হয়ে বসে গেছে। ইতিমধ্যে পুঁজিপন্থিরা ‘ভালোবাসা দিবস’ নিয়ে এসেছে, যেটি ‘উদযাপিত’ হয় একুশে ফেব্রুয়ারির এক সপ্তাহ আগে। জামা কাপড়ের ও ফুলের ব্যবসায়ীরা ভালো আয় উপার্জন করে। তরুণদের চোখ ওই হাল ফ্যাশনের দিকে ছুটেছে। মুক্তির সংগ্রাম কি তাহলে আত্মসমর্পণ করেছে পুঁজিবাদের কাছে? দায়ী কে? দায়ী কি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব? এ প্রশ্নের জবাব দরকার হবে বৈকি।(সৌজন্যে:দেশরূপান্তর)
লেখক
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়