ট্রাম্পের ভারত সফর এবং দুর্দশাময় ভারতবর্ষ
সৌমিত্র দস্তিদার:আমরা তখন ছোট। বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ আছড়ে পড়েছে ভারতের অলিগলিতে। কলকাতা শহর পুরোপুরি অগ্নিগর্ভ। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিচ্ছে নতুন নেতৃত্ব। কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, সন্তোষ রানা, বাবুলাল বিশ্বকর্মা, অসীম চ্যাটার্জিসহ আরও কত কত নাম। তাদের নিয়ে জন্ম নিচ্ছে অজস্র নতুন নতুন গল্পগাথা। সেরকমই একটি নাম তখন লোকের মুখে মুখে ফিরত। তিনি হলেন অসীম চ্যাটার্জি। তিনি লোকের কাছে পরিচিত ছিলেন কাকা নামে। প্রেসিডেন্সি কলেজের তুখোড় ছাত্র তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজ তখনো মূলত অভিজাত পড়–য়াদের জায়গা। রাজ্যের আমলা-মন্ত্রীদের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ সেখানকার ছাত্র। এরকমই কোনো এক বিশিষ্ট আমলার মেয়ের জন্মদিনে অতিথি ছিলেন কাকা। কাকা তখন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। অতি সাধারণ পোশাকে, হাওয়াই চটি পায়ে দিয়ে কাকা গেছেন শুনেই মেয়েটির বাবা এলেন আলাপ করতে। কিছু কথার পরেই বিশিষ্ট আমলা রাখঢাক না করে কাকাকে বল্লেন ‘এরকম একটা পার্টিতে, শুভ অনুষ্ঠানে তোমার লজ্জা লাগছে না এই আধময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি গায়ে বসে থাকতে!’ শোনা যায়, কাকা সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোককে পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন ‘যে দেশে এত লোক খেতে পায় না, সেখানে জন্মদিনে এরকম বিপুল টাকা নয়-ছয় করতে লজ্জা হয় না। নিচে গিয়ে দেখুন আপনাদের ফেলা খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে মানুষ ও কুকুর। এর চেয়ে অশ্লীল আর কিছু হয় নাকি!’
কেন জানি না আজ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর নিয়ে চারপাশের সংবাদমাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া কাকার গল্পটা। যে সময়ে তিনি আসছেন তখন গোটা দেশ অগ্নিগর্ভ। মিছিলে-অবরোধে-অনশনে-সত্যাগ্রহে ভারতের জনতার বড় অংশ রাস্তায়। শুনছি ট্রাম্প নাকি এদেশের বাকস্বাধীনতা ও ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেন। কদিন ধরেই শুনছি তিনি আসছেন। সপরিবারে দেখতে চান প্রিয় বন্ধু নরেন্দ্র মোদির রাজ্যপাট কেমন চলছে!
অবশ্য মুখ খুললে তা নিশ্চিতভাবে কিছুটা হলেও মোদি সরকারের পক্ষে বিড়ম্বনার কারণ হবে। যদিও ট্রাম্প নিজের দেশেই যে বিভাজন নীতি অনুসরণ করে আসছেন তাতে মোদিকে তিরস্কার কিছুটা যেন বড় দাদার ছোট, আদরের ভাইকে স্নেহ ভর্ৎসনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাণিজ্য প্রশ্নে ভারত কতটা কী আদায় করতে পারবে এখনই বলা কঠিন। তবে ভারতের বিপুল বাজারে লগ্নি করতে মার্কিন প্রশাসন যে আগ্রহী তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মোদি ট্রাম্পের পারস্পরিক বৈঠকে নিশ্চিত প্রতিরক্ষা বিষয়টি সব থেকে বেশি গুরুত্ব পাবে। ভারতে এর আগে বহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট এসেছেন। ভাষণ দিয়েছেন, চুক্তি সই করে চলেও গেছেন। কিন্তু এবারের ট্রাম্পকে নিয়ে যে মাতামাতি হচ্ছে তা আগে কখনো ভারত দেখেনি। এ এক ধরনের নির্লজ্জ তোষামোদ। যা ভারতের একদা জোটনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে একেবারে বেমানান। এমনভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে তোয়াজ করা হচ্ছে যা শুধু দৃষ্টিকটু নয়, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়েও সংশয় জাগায়। সবাই জানেন যে এই মুহূর্তে ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব খারাপ। শিল্পে মন্দা চরমে। বেকারি বাড়ছে দ্রুতগতিতে। কৃষক আত্মহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমন সময় ঘটা করে ট্রাম্প বন্দনার একটাই উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তা হলো, স্তাবক ভক্তদের দেখানো ‘দেখো দেখো আমাদের মোদিজির কত্ত ক্ষমতা। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ওঠাবসা। বিশাল এক শক্তিশালী রাষ্ট্র যার সহায় তাকে হারাবার সাধ্য কার!’
এই বিরাটত্ব দেখানোর পেছনে কোনো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে কি না তা মনোবিদরা বলতে পারবেন। কিন্তু এটা ঠিক ট্রাম্প ও মোদিজি দুজনেরই এক বিপুল শক্তির প্রতি অমোঘ টান আছে। বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি হয়েছে বিপুল টাকা খরচ করে আবার বিরাটকায় রাম মন্দিরও হবে ওইরকম বিশাল। সাধারণভাবে মনে হয়, এই বিশাল নির্মাণ একধরনের আত্মম্ভরিতার নির্লজ্জ প্রকাশ। সমস্যা হচ্ছে পঞ্চাশ ও ষাট দশকে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় ছিলেন জওয়াহেরলাল নেহরু, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, আনোয়ার সাদাত, মাও সে তুং, চৌ এন লাই-এর মতো রাষ্ট্রনায়করা। তাদের পাশে এই অহংসর্বস্ব মেগালোম্যানিয়াক রাষ্ট্রনায়করা যতই লম্ফঝম্প করুন না কেন ইতিহাসের বিচারে তারা যে নিতান্তই লিলিপুট তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ট্রাম্প চলেছেন বন্ধু নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে তারই শহর গুজরাটে। নির্দিষ্ট করে বললে আহমেদাবাদে। মনে পড়ে গেল ২০০২-এ গুজরাট গণহত্যার পর পরই আমেরিকায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। এদিক দিয়ে মোদির নিশ্চয়ই ধন্যবাদ প্রাপ্য। যে দেশ একদিন হত্যার ‘অপরাধে’ ঢুকতে দেয়নি, তারই রাষ্ট্রপ্রধান আজ নিজে এসে মোদিজিকে বুকে জড়িয়ে সব দোষ মার্জনা করে দিলেন। কূটনৈতিক কৌশলে ভারত সম্রাট নিজের গায়ে যেটুকু যা কালি তা মুছে দিলেন স্বয়ং ট্রাম্পকে দিয়েই। মুশকিল হচ্ছে ইতিহাস সব দোষ ক্ষমা করে না। আহমেদাবাদের রাস্তায়, গলিতে, ঘিঞ্জি মহল্লায় এখনো কান পাতলে শুনতে পাবেন অসংখ্য সন্তানহারা মা, স্বামীহারা স্ত্রী কিংবা মেয়েহারা বাবার আর্তনাদ। এখনো কত ধর্ষিতা বিচারের আশায় দিন গুনছেন। ট্রাম্প সাহেব কখনো কোনোদিনই তাদের দেখা পাবেন না। ট্রাম্প যে রাস্তা দিয়ে মূল অনুষ্ঠানের আসরে যাবেন, তার একটা বড় অংশ পাঁচিল তুলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাতে তার চোখে বিপুল গরিব বস্তির অপরিসীম যন্ত্রণা আচমকা সামনে না পড়ে। পাঁচিলের আড়ালে রয়ে গেছে গরিব মানুষের যাপন চিত্র। বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জল নেই। মেয়েদের রাত থাকতেই খোলা আকাশের নিচে প্রাতঃকৃত্য সারতে হয়। এভাবেই স্বচ্ছ ভারত ঠাট্টা করে নগ্ন ভারতকে । মোদি সরকারের উন্নয়ন মডেল মুখ থুবড়ে পড়ে যন্ত্রণা বিষাদের আহমেদাবাদের রাস্তায়। যন্ত্রণা বিষাদের পাশাপাশি প্রাচুর্যের এই সহাবস্থান জন্ম দেয় এক অশ্লীল মহাকাব্যের। যা ভারতের জনমনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেল। এই তিন ঘণ্টার ট্রাম্পের পারিবারিক সফরে খরচ মাত্র একশো কোটি টাকা। বহুঘোষিত গণতন্ত্র কখন কীভাবে যে সামন্ত শাসন হয়ে যায় কেউ তা টেরও পাই না।
লেখক : ভারতের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা(সৌজন্যৈ:দেশরূপান্তর)