হত্যা নয়, আত্মহত্যাই
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদনে জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শাবনূরের নাম জড়ানোয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে গণমাধ্যমের কাছে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। এ অভিনয়শিল্পী বলেন, ‘একজন মৃত মানুষের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কথা বলাটা খুব বিশ্রী মনে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কিসের জন্য আমার নাম জড়ানো হচ্ছে! সালমান যদি আত্মহত্যাও করে, তাহলে আমার কারণে কেন করবে! আমার নামটা জড়ানোর আগে সবারই একবার ভাবা উচিত।’
শাবনূর বলেন, ‘আমাকে জড়িয়ে এমন কথা কেন বলা হচ্ছে, তা আমি জানি না! সালমান ও আমাকে জড়িয়ে এ ধরনের কথা কেউ যদিও বলে থাকে, সেটার আমি ঘোর বিরোধিতা করছি। সালমান শুধুই আমার নায়ক ছিল, সহশিল্পী ছিল, বন্ধু ছিল, এর বাইরে আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমি আগেও বলেছি, তাকে আমি ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। তার সঙ্গে আমার ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল। অন্যরকম পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক ছিল। এটা নিয়ে এখন কেউ কিছু বললে তা তো আমি মানবই না। একজন মরা মানুষকে নিয়ে এত বছর পর এত বিশ্রী কথা বলার মন-মানসিকতা কীভাবে সবার হয়, সেটাও আমি বুঝি না।’
শাবনূর বলেন, ‘আমি তখন অবিবাহিত একটা মেয়ে। সালমান তো বিবাহিত। ওর স্ত্রীর সঙ্গেও আমার একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। সালমানের স্ত্রী সবসময় আমাদের সঙ্গেই থাকত। প্রেমের সম্পর্কের কিছু একটা যদি হতো, এটা তখন সবাই বুঝতে পারত। এত বছর পর এ ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে জড়িয়ে নোংরা উক্তি করার ব্যাপারটি মোটেও ভালো লাগছে না। কিছু মানুষ আমাকে জড়িয়ে গুজব ছড়িয়েছে। এখনো ছড়াচ্ছে।’
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ধানম-িতে পিবিআই সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইপ্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, দুই যুগ আগের ওই ঘটনার তদন্তে হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের। অনেকেই মৃত্যুবরণ করায় তাদের সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। আলোচিত ওই মৃত্যুর রহস্য ঘিরে চলচ্চিত্র অঙ্গনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম উঠে এলেও তার কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি পিবিআই।
সংবাদ সম্মেলনে স্কেচের মাধ্যমে ঘটনার সচিত্র তুলে ধরা হয়। পিবিআইপ্রধান জানান, আজ মঙ্গলবার আদালতে মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে পিবিআইর করা তদন্তে সালমান শাহর আত্মহত্যার পেছনে পাঁচটি কারণ উঠে এসেছে। আত্মহত্যার পেছনে শাবনূর ছাড়াও তার স্ত্রী সামিরার সঙ্গে বিভিন্ন কারণে দাম্পত্য কলহ, মাত্রাধিক আবেগ প্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টা, মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রূপ নেওয়া ও সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।
সংবাদ সম্মেলনে এ আত্মহত্যার পেছনে প্ররোচনাকারী শাবনূর কি ন এমন প্রশ্নে বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা তার আত্মঘাতী হওয়ার পেছনে পাঁচটি কারণ বলেছি। প্ররোচক হিসেবে কাউকে আমরা পাইনি। এটি তার নিজের সিদ্ধান্ত। শাবনূরকে আমরা তিনবার ডেকেছি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, একজন কো-আর্টিস্ট হিসেবে সালমানের সঙ্গে যতটুকু ভালো সম্পর্ক থাকা দরকার সেই সম্পর্ক তার ছিল। এর আগের দিন সালমানের সঙ্গে তিন ঘণ্টা ডাবিং করেছেন। তখন সালমানকে নরমালই মনে হয়েছে। ঘটনার দিন ১২টার দিকে মৃত্যুর খবর পান। পরে আর লাশ দেখতে যাননি, বাসায়ও যাননি।
সালমান শাহর ফ্ল্যাটে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের আসা-যাওয়া ছিল, তার কোনো জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সাক্ষ্যপ্রমাণে কেউ স্পষ্ট করে বলেননি আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওই ফ্ল্যাটে যেতেন কি যেতেন না। তারা বলেছেন, সিনেমা জগতের প্রচুর লোক আসত।’ ময়নাতদন্তের সময় ভিসেরা পিজার্ভ করা হয়েছিল সেই ভিসেরা রিপোর্ট আপনারা পেয়েছেন, কিন্তু যিনি ভিসেরা রিপোর্ট দিয়েছেন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাকে আর পাওয়া যায়নি। সালমান শাহ মানসিক রোগী ছিলেন এমন কোনো মেডিকেল হিস্ট্রি পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে পিবিআইপ্রধান বলেন, ‘আমরা এমন কোনো হিস্ট্রি পাইনি। এ ধরনের ডিপ্রেশন নিয়ে আমাদের দেশে কেউ ডাক্তারের কাছে যান না। তবে তিনি রক্ত দিয়ে চিঠি লিখতেন, এই প্রবণতা ছিল। তার বন্ধুরা সবাই বলেছেন তিনি অত্যন্ত অভিমানী ছিলেন। একবার ৯০টি ইনোকটিন (ঘুমের ওষুধ) খেয়েছিলেন, স্যাভলনও খেয়েছিলেন। তাকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে ওয়াশ করা হয়।’
পিবিআইর বক্তব্যে সালমান শাহর মা সন্তুষ্ট কি না জানতে চাইলে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমরা তদন্ত করি না। আমাদের কাছে তদন্ত করতে এলে কারও পক্ষেও যেতে পারে কারও বিপক্ষেও যেতে পারে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সালমান শাহ দুটি ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন। এর বাইরে কোনো সিগারেট ছিল কি না তা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তার বাসায় বহু ধরনের জুতা ছিল।’ রুবি নামে এক নারীর ভিডিও বার্তায় সালমান শাহকে হত্যার দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বনজ কুমার বলেন, ‘সালমান শাহর বাসার কাছে মে ফেয়ার বিউটি পার্লারের মালিক ছিলেন রুবি। বর্তমানে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় বসবাস করেন। আমাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি একটি বক্তব্য দিয়ে হুলুস্থূল বাধিয়ে ছিলেন। এরপর তিনি আরও একটি বক্তব্য দেন। আমেরিকা থেকে আমাদের কাছে এক নোটারি অ্যাডভোকেট চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, রুবি এরই মধ্যে একটি বক্তব্য দিয়েছেন যে তার আগের বক্তব্য সঠিক নয়। তিনি বাই পোলার ডিজঅর্ডার নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত। তিনি যখন অসুস্থ ছিলেন সেই পরিস্থিতিতে বক্তব্যটি আপলোড করেছেন। তিনি যা বলেছেন সেটি সঠিক না।’
এর আগে লিখিত বক্তব্যে বনজ কুমার বলেন, ‘২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর আমরা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করি। ২৫ বছর আগের ঘটনা অনুসন্ধানে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। তদন্তের ভিত্তিতে পিবিআই ৬০৯ পৃষ্ঠার ডকেট তৈরি করেছে। ঘটনার সময় যারা দেখেছেন, বলেছেন এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তাদের খুঁজে বের করা খুবই কঠিন হয়েছে। সালমানের তখনকার স্ত্রী সামিরাসহ ৪৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করা হয়। এর আগে সালমানের বাবা, মা, ভাই ও ভাইয়ের বন্ধু মাসুম দেওয়ান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। এর মধ্যে তার বাবা মারা গেছেন। অন্যদের জবানবন্দি আলাদা করে গ্রহণ করিনি। মৃত্যুর আগে যে সুইসাইডাল নোট লেখে যান সেটি সালমান শাহর হাতের লেখা বলে মতামত দিয়েছেন পুলিশ বিভাগের হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্ট নামে ক্ষাতমান সমির কুমার মুখার্জি। বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এটি যাচাই করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘সালমানের তখনকার স্ত্রী সামিরা আদালতকে জানান, ১৯৯০ সালের ১২ জুলাই চিটাগং ক্লাবে ফ্যাশন শোতে সালমান শাহর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পরে ঢাকায় ফুপুর বাসায় পড়তে এলে সালমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তার। ১৯৯১ সালে ২০ ডিসেম্বর তারা গোপনে বিয়ে করেন। সালমান শাহর মা সামিরাকে খুব মারধর করায় তারা আলাদা বাসা নিয়ে থাকতেন। চিত্রনায়িকা শাবনূর তার বাসায় প্রায়ই আসত, যখন-তখন টেলিফোন করত এটি তার পছন্দ ছিল না। ১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগের দিন সামিরা এফডিসিতে যান সালমান শাহর মুভির ডাবিং দেখতে। ডাবিং রুমে গিয়ে সালমান শাহ ও শাবনূরকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে পেয়ে রাগ করে বের হয়ে আসেন সামিরা। সালমান ও বাদল খন্দকার একসঙ্গে বাসায় চলে আসে। ওইদিনই রাত সাড়ে ১১টার সময় শাবনূর সালমানকে ফোন করে, কিছু সময় পর আবার ফোন করে। দুবারই সালমান বাথরুমে গিয়ে শাবনূরকে চিৎকার করে বলে “তুমি আর বাসায় ফোন করবা না”। রাত ১২টার সময় আবার ফোন করে শাবনূর। তখন সালমান রাগ করে শাবনূরের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া সিটিসেল ফোন ও একটি টেবিল ফ্যান ভেঙে ফেলে। তখন সামিরা বাসা থেকে বের হয়ে নিচে চলে আসেন। তাকে নিচে আটকে পরবর্তীতে বুঝিয়ে ঘরে আনা হয়। রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। সালমান শাহর বডিগার্ড আবুল হোসেন খান বক্তব্য দিয়েছে, ঘটনার দিন সকালে বাজার থেকে এসে দেখেন কয়েকজন পরিচালক বাসার নিচে এসেছেন। তখন বাসায় গিয়ে সামিরাকে বলেন, ভাবি কয়েকজন পরিচালক আসছে ভাইকে ডেকে দেন। তখন চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখতে পান সালমান শাহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে।’ তিনি বলেন, ‘ওই বাসার গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম জানিয়েছেন, রাতে দুজন শাবনূরকে নিয়ে ঝগড়া করতে করতে ঘরে ঢোকেন। সালমান দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। সালমান চেয়েছিলেন যে শাবনূরকে বিয়ে করে দুই স্ত্রী নিয়েই থাকবেন। কিন্তু সামিরা বলেছেন তিনি সতীনের সংসার করবেন না। প্রয়োজনে তালাক দিয়ে বিয়ে করতে বলেন সালমানকে। তাদের বাচ্চা ছিল না। ওমর নামের এক ছেলেকে বাচ্চা হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। মনোয়ারা বেগম আরও জানান, সালমান শাহ বাসায় কখনো কিছু চেয়ে খেতেন না। নিজের কাজ নিজে করতেন। মনোয়ারা যখন রান্না করছিলেন তখন সালমান তার মগ নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে তার কাছে দুই গ্লাস পানি চেয়ে খান। পরে ড্রেসিংরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন।’
পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডের ১১/বি ইস্কাটন প্লাজার ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে সালমান শাহর মরদেহ উদ্ধার করেন স্বজনরা। ওই সময় এ বিষয়ে রমনা মডেল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। মামলার এজাহারে বলা হয়, ৬ সেপ্টেম্বর সকাল অনুমানিক সাড়ে ৯টার সময় ছেলে সালমান শাহর বাসায় দেখা করতে যান তিনি। বাসায় যাওয়ার পর সালমান ঘুমাচ্ছে শুনে ফিরে আসেন। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার সময় চলচ্চিত্র প্রোডাকশন ম্যানেজার সেলিম তাকে ফোন করে জানায় সালমান শাহর যেন কী হয়েছে এবং তাকে দ্রুত সালমান শাহর বাসায় যেতে বলেন। তখন তিনি, তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে দ্রুত সালমান শাহর বাসায় গিয়ে দেখেন সে শয়নকক্ষে মরার মতো পড়ে রয়েছে। তখন তিনি উপস্থিত লোকজনদের সহায়তায় সালমান শাহকে বাসা থেকে বের করে দ্রুত নিকটস্থ ‘হলি ফ্যামিলি’ হাসপাতালে নিয়ে যান। যাওয়ার পথে তারা সালমান শাহর গলায় দড়ির দাগ এবং মুখমণ্ডল ও হাত-পা নীলাভ বর্ণের দেখেন। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে গেলে কর্র্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার সালমান শাহকে মৃত ঘোষণা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইপ্রধান বলেন, ‘তদন্তে সালমানের ছোট মামা আলমগীর তাদের জানিয়েছেন, ঘটনার আগের রাত ১২টার একটু পর ফোন করেন সালমান। বলেন, আমি সকালেই সামিরাকে নিয়ে সিলেট আসতেছি। আমি তাকে তালাক দেব। তাকে নিয়ে আমি সংসার করব না। তিনি এটি শুনে সকালে বাজার করেন। দুপুরে মৃত্যুর খবর শুনতে পান। তিনি সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীকে বলেন, কেন তোমরা ওদের আলাদা থাকতে দাও। নীলা চৌধুরী তখন বলেন, সামিরার অনেক বন্ধুবান্ধবী বাসায় আসত। এজন্য ওরা বাসা ছেড়ে আলাদা বাসা নিয়েছে।’