যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন কেন
সায়েমা খাতুন:বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে গড়ে ওঠা জোরদার যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের মধ্য থেকে মাইলফলক অর্জন হলো বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির রিটের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাঙ্গনে এবং কর্মস্থলে যৌন হয়রানি নিরোধে ২০০৯ এর ১৪ মে জারিকৃত হাইকোর্টের যুগান্তকারী নির্দেশনা। যৌন হয়রানি নিরোধে অপর্যাপ্ত আইনি পরিকাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনাই আইন হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু এর সীমাবদ্ধতা হলো কোনো নাগরিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত না হলে সরাসরি অভিযোগ দায়ের করতে আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন না। অথচ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, গবেষণার পরিসংখ্যান এবং নারী ও শিশুদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতায় যৌন হয়রানির ভয়ংকর বিস্তারে সর্বস্তরের নাগরিকদের মধ্যে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগঠনের জোট জেন্ডার প্লাটফর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিমুক্ত প্রবেশ নিশ্চিত করতে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনাকে অগ্রসর করবার লক্ষ্যে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ২০১৮ (প্রস্তাবিত) প্রস্তুত করে আইন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে পেশ করে। কিন্তু এই আইন সংসদে উত্থাপনে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে।
যৌন হয়রানির ভয়াবহ চিত্র : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী সোহাগ পরিবহনের চলন্ত বাসের সব যাত্রী নেমে গেলে একা পড়ে যান। তিনি নেমে যেতে চাইলে বাসের দুজন কর্মী তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন। বাস চলতে শুরু করলে সেই দুজন তার হিজাব খুলে মুখ দেখার চেষ্টা করে এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। তিনি চিৎকার করতে শুরু করলে বাসের ড্রাইভার তাকে ছেড়ে দিতে বললে শেষ পর্যন্ত তিনি ছাড়া পেতে সক্ষম হন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘মনে হলো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলাম’ (নভেম্বর ২৮,২০১৯)। মানিকগঞ্জের সাঁটুরিয়া গ্রামে দশম শ্রেণির ছাত্রীর প্রেমিকের কাছ থেকে নগ্ন ছবির ভিডিও প্রকাশের হুমকি পেয়ে এবং ধারাবাহিক ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে (১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)। নাটোরের ডিসির বিরুদ্ধে একজন সহকর্মী গভীর রাতে অশোভন টেক্সট মেসেজ পাঠানো ও ইঙ্গিতপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ করেন। ওই ডিসি তাকে কাজের পরেও বেশি সময় থাকবার জন্য জোরাজুরি করেন। লোকপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বরাবরে এক চিঠিতে তিনি এই অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ওএসডি করা হয়। (২৫ নভেম্বর ২০১৮)। ফেনীর সোনাগাজী ইউনিয়নের মাদ্রাসা ছাত্রীকে প্রিন্সিপাল কর্র্তৃক যৌন নির্যাতন এবং বীভৎসভাবে হত্যার ঘটনা দেশবাসীকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল ময়মনসিংহের গৌরীপুর পুলিশ স্টেশন ব্যারাকে ২৩ বছর বয়সে কনস্টেবল হালিমা বেগম নিজের দেহে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি একই স্টেশনের সাব ইন্সপেক্টর মিজানুল ইসলামের দ্বারা ধর্ষিত হন বলে একটি বিবৃতি রেখে যান। কিন্তু থানার ইনচার্জ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ঢাকা ট্রিবিউনের একটি সিরিজ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কর্মস্থলে মেয়েদের যৌন হয়রানি অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাকরি হারানোর ভয়ে অথবা লোকলজ্জায় রিপোর্ট করা হয় না (মে ২১, ২০১৮)। বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের সম্মেলনে বলা হয়, সাংবাদিকরা নিজেরাও দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন সময়ে বস, সহকর্মী অথবা অন্য কারও দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, অথচ, চাকরি হারানোর ভয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারছেন না (২৩ অক্টোবর, ২০১৮)। ২০১৮ সালের ৬ মার্চ প্রকাশিত ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৯৪% নারী জনপরিবহনে চলাচলের সময় মৌখিক, দৈহিক এবং অন্য ধরনের যৌন হয়রানির শিকার, যার প্রধান যৌন আক্রমণকারীরা ৪১-৬০ বছর বয়েসী পুরুষ। কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০% নারী পুলিশ তাদের কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হন।
হাইকোর্টের শক্তিশালী ভূমিকা এবং নিপীড়ন সেলের ব্যর্থতা : বাংলাদেশের হাইকোর্ট যৌন হয়রানি নিরোধে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গনে এবং কর্মস্থলে যৌন হয়রানি নিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনাই পূর্ণাঙ্গ আইনের অনুপস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, হাইকোর্টের নির্দেশনার এক দশক পরেও অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া আউটলেটগুলোতে যৌন নিপীড়ন অভিযোগ কমিটি তৈরি করা হয়নি। দেশের ৪০% বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অভিযোগ কমিটিই নেই। আবার যে সব প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে সেগুলোকে অকার্যকর হয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে অথবা স্বয়ং ভিকটিমের সঙ্গে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো হাইকোর্টের ১১টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই যৌন হয়রানি রোধে নিজস্ব কোনো নীতিমালাও নেই। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, স্বয়ং হাইকোর্টেই অভিযোগ কমিটি গঠন করা হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গোড়া থেকেই কমিটি গঠন করা হলেও বিভিন্ন সময়ে স্বয়ং কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীকে অসহযোগিতা এবং অপদস্থ করবার অভিযোগ রয়েছে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনা ছাড়াও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ (২) ধারা অনুসারে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবার অভিযোগে দুই থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। বিদ্যমান আইনগুলোর আওতা বিশ্লেষণ করে ব্যারিস্টার সাবরিনা জারিন বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, যেমন ধর্ষণ, দল বেঁধে ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা সংজ্ঞায়িত ও শাস্তিনির্ধারিত করা হয়েছে। নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যায় বাধ্য করাও এর অন্তর্ভুক্ত। পারিবারিক সহিংসতা দমন ও সুরক্ষা আইন ২০১০ এ যৌন নির্যাতন সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে আমাদের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ধারা ৩৫৪ এবং ৫০৯ যাতে যৌন নির্যাতন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পর্নোগ্রাফি আইন ২০১২, টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮-এ বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ এ নারীদের অশালীন কথা ও কটূক্তিকে অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়াও শ্রম আইন ২০০৬ (২০১৩ ও ২০১৮ তে সংশোধিত) এর আওতায় অশোভন আচরণ ও যৌন হয়রানির বিচার করা যায়।’
দেশের বিদ্যমান এইসব আইন সত্ত্বেও যৌন হয়রানির জন্য পৃথক ও সুনির্দিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয়তা হাইকোর্টের নির্দেশনাতেই বলা হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমা আলী বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা দিয়ে আমাদের কাজ চালাতে হলেও শেষ পর্যন্ত এর চূড়ান্ত মোকাবেলায় পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি কাজী রেজাউল হক বলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ এবং সরকারের একযোগে আইন প্রণয়নের জন্য কাজ করা উচিত। আইন থাকলে অত্যাচারিত নারীরা অভিযোগ দায়ের করতে ভরসা পাবেন এবং আইনি পরিকাঠামোতে নারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকলে যৌন অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে।’ (ঢাকা ট্রিবিউন, মে ২১,২০১৮)
শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি গঠন, তদন্ত এবং রায় প্রদান করবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবলেরও বিশেষ অভাব রয়েছে। যৌন হয়রানি সম্পর্কে পরিষ্কার বোঝাবুঝি নিয়েও ব্যাপক সমস্যা রয়ে গেছে। যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্ত ও পরিচালনাতে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ আরোপ থেকে মুক্ত হওয়া এবং ভিকটিমের জন্য অসম্মানজনক আচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যদের হতাশাব্যাঞ্জক ভূমিকা গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হচ্ছে। এমন নজির সামনে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ কমিটি ক্যাম্পাসের দলীয় রাজনীতির প্রভাবে অভিযোগের তদন্তের গতি বাড়িয়ে-কমিয়ে-ঝুলিয়ে দিয়ে, কৌশল ও ছল-চাতুরীর মাধ্যমে নিপীড়িত শিক্ষার্থীকে ন্যায়বিচার লাভে বাধাগ্রস্ত করছে, আবার অন্যদিকে অভিযুক্তকেও ক্ষমতাসীন দলের নির্দেশনা অনুসারে চলতে বাধ্য করছে।
ইমারজেন্সি মোকাবিলায় পূর্ণাঙ্গ আইনি পরিকাঠামো : যৌন নিপীড়ন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মানব নিরাপত্তার জন্য এটি একটি ইমারজেন্সি অবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। যদিও পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোয় নারীর অধস্তনতার সংস্কৃতির গভীরে যৌন নিপীড়নের শেকড় প্রোথিত, যার অবসান ঘটা সম্ভব একটা দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে, কিন্তু এই সময়ের যৌন হয়রানির ব্যাপকতা রোধে আশু একটি সুস্পষ্ট আইনি পরিকাঠামোর শক্তপোক্ত বাতাবরণের কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্র্তৃক গত ২০১৯ সালের ১০ জুন জেনেভাতে অনুষ্ঠিত সংস্থাটির ১০৮তম সেশনে ‘Elimination of Violence and Harassment in the world of work’ শীর্ষক কনভেনশন ১৯০-এ বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি নিরসনে একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা গ্রহণ করে। এই কনভেনশনের প্রস্তাবনা বাংলাদেশসহ কিছু দেশ এখনো অনুসমর্থন করেনি। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে এই কনভেনশনের প্রস্তাবনা একদিকে একটি শক্তিশালী ফ্রেমওয়ার্ক ও সুরক্ষা কবচ। এতে বলা হয়েছে : ‘Without prejudice to and consistent with Article 1, each Member shall adopt laws and regulations to define and prohibit violence and harassment in the world of work, including gender-based violence and harassment.’
যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন মানুষ হিসেবে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার খর্ব করে, অনেক ক্ষেত্রে তার শিক্ষাগ্রহণকে ব্যাহত করে এবং কর্মজীবনে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অপরিমেয় শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতি, মর্যাদাহানি এবং নারীর জীবনের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে, নারীর পরিবার এর ফলে অবর্ণনীয় দুর্দশা, যন্ত্রণা ও অসম্মান ভোগ করে। তাই যৌন হয়রানি বন্ধে সরকারকে আইন, বিচার ও প্রশাসন রাষ্ট্রের এই তিন অঙ্গের সবকটি দ্বারা নারীর জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা প্রদানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সি ১৯০ অনুসমর্থন এবং প্রস্তাবিত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হবে এই প্রচেষ্টার দুই স্তম্ভ।
লেখক
সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়( সৌজন্যে:দেশরূপান্তর)