ট্রাম্পের ভারত সফর এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ
তারেক শামসুর রেহমান:আজ দুদিনের ভারত সফরে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুধু ভারতবর্ষ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের এটাই প্রথম সফর। এ সফরের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে– ট্রাম্পকে বহনকারী এয়ারফোর্স-১ বিমানটি ভারত সফরে প্রথম অবতরণ করবে গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদে। গুজরাটের তিন-তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি (২০০১-২০১৪)। আহমেদাবাদ সরদার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মোদি ট্রাম্পকে স্বাগত জানাবেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ভারত সফরের সময় (সেপ্টেম্বর ২০১৪) প্রেসিডেন্ট শি’ও আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে প্রথম অবতরণ করেছিলেন। ভারতের অর্থনৈতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র গুজরাট। গুজরাটের উন্নয়নকে মোদি একটি ‘মডেল’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। এ কারণেই বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা যারাই ভারতে আসেন, প্রথমে তারা নামেন আহমেদাবাদে। তারপর যান নয়াদিল্লি। ট্রাম্পও প্রথমে নামবেন আহমেদাবাদে, তারপর যাবেন নয়াদিল্লি।
ট্রাম্পের এই সফর অনেকগুলো কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প তার ভারত সফর শুরু করার আগে গেল বছরই (জুন ২০১৯) ভারত বাণিজ্যে যে জিএসপি (GSP- Generalised System of Preference) সুবিধা পেত, তা বাতিল করে দিয়েছিলেন, যা ভারতে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র অনুন্নত দেশগুলোকে তাদের রপ্তানি পণ্যে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ভারত বর্তমানে আর অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নেই। ভারত ধীরে ধীরে উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতি ভারতের (জিডিপি সাধারণ হিসেবে ২ দশমিক ৯৪ ট্রিলিয়ন ডলার আর ক্রয়ক্ষমতার হিসাবে-পিপিপিতে এর পরিমাণ ১০ দশমিক ৫১ ট্রিলিয়ন)। সুতরাং ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত যে ট্যারিফ সুবিধা পেত, তা বাতিল করে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন একটি বার্তা দিয়েছিলেন তারা কী চান। ট্রাম্প এও বলেছিলেন যে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। সেই থেকে অর্থাৎ গত বছরের জুন থেকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য এক ধরনের ‘অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা’র মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে স্পষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। দিল্লি চায় ভারতীয় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করুক ওয়াশিংটন। বিনাশুল্কে মার্কিন বাজারে নির্দিষ্ট কিছু ভারতীয় পণ্যকে ঢুকতে দেওয়া হোক। অন্যদিকে কৃষিজাতপণ্য ও চিকিৎসা যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ডিজিটাল পণ্যসহ তাদের একাধিক পণ্য থেকে ভারত শুল্ক প্রত্যাহার করুক এমনটাই দাবি তাদের। ট্রাম্প এর আগে প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছিলেন যে, মার্কিন বাজারে ভারত বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও, ভারতীয় বাজারে মার্কিন পণ্যকে শুল্কছাড় দেওয়া হয় না। বড় ধরনের বাণিজ্যচুক্তি নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন ট্রাম্প। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে পছন্দ করেন এ কথাটা জানাতে ভোলেননি। পাঠক, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে প্রবাসী ভারতীয়দের উন্মুক্ত অনুষ্ঠান Howdy Modi-এর কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই অনুষ্ঠানে মোদি ও ট্রাম্প উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই একই আদলে এবার ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় আহমেদাবাদের Moetera Stadium-এ Kemcho Trump অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে ট্রাম্প ও মোদি একসঙ্গে উপস্থিত থাকবেন। Kemcho Trump গুজরাটি ভাষা এর অর্থ কেমন আছেন ট্রাম্প। এক লাখ লোক উপস্থিত থাকবেন ওই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে ট্রাম্প নিশ্চয়ই গুজরাটি ভাষায় জবাব দেবেন Majama chu অর্থাৎ আমি ভালো আছি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদি এ মুহূর্তে খুব ভালো আছেন, এটা বলা যাবে না। কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে দিয়ে মোদি যে বিতর্কের সূচনা করেছিলেন, তার অবসান হয়নি। কাশ্মীর মূলত এখন এক ধরনের ‘বন্দিশিবিরে’ পরিণত হয়েছে। কাশ্মীরি নেতারা এখন গৃহবন্দি। পাকিস্তান একাধিকবার কাশ্মীর প্রশ্নটি জাতিসংঘে উত্থাপন করেছে। আর ট্রাম্প নিজে কাশ্মীর প্রশ্নে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব করেছিলেন, যা কি না ভারত সরকার শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং জানিয়ে দিয়েছিল এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এমন বেশ কটি ইস্যুতে দুদেশের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও, ট্রাম্প ভারত সফরকে বেছে নিলেন কেন? এর পেছনে রয়েছে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দু-দুবার ভারত সফর করেছেন। ওবামা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘defining partnership’। একুশ শতকে বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকটাই নির্ভর করবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর এমন মন্তব্যই ছিল ওবামার। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ওবামা ভারতের রিপাবলিকান ডে’র অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় প্রায় ২০০ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল নিয়ে ওবামা ভারত সফর করেছিলেন। ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করার মাত্র ছয় মাসের মাথায় মোদি যখন রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রিত হন (২০১৭) তখনই এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, দুদেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। মোদির ওই সফরে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে দেখা যায়, ভারত প্রায় ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয় করবে। এর মধ্যে ড্রোনও ছিল। এটা পাকিস্তানের জন্য একটি বাড়তি ‘চাপ’ সৃষ্টি করেছিল। কেননা, এরই মধ্যে ঘোষিত হয়েছে যে, পাকিস্তান চীন থেকে ১০০টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ক্রয় করবে। ভারত কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত উপমহাদেশে এক ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিল। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে চীন একটি ফ্যাক্টর। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকদের কাছে এটা এখন স্পষ্ট যে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনা প্রভাব কমাতে ট্রাম্প প্রশাসন আগামী দিনে ভারতকে ব্যবহার করবে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিরোধ, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তার পাশে চায়। ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কিছুদিন আগে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল, যা চীন খুব ভালো চোখে দেখেনি। এমনিতেই দোকলাম ঘটনার পর (২০১৭) চীন-ভারত উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পেলেও, দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয়েছে, এটা বলা যাবে না। চীনের মহাপরিকল্পনা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এ ভারত যোগ দেয়নি। চীনের এই মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে ভারতের সন্দেহ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তার প্রভাব বাড়াতে চায়, এটা ভারতের পছন্দ নয়। এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক। আফগান প্রশ্নেও দুদেশের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে আফগানিস্তানে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ও ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলেও, ভারত যখন ইরানের চাহবাহার (সিসতাজ বেলুচিস্তানের বন্দর) বন্দর উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় এবং চাহবাহার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ শুরু করে, তখন এই পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আপত্তি ছিল না। চীন যখন গাওদার (পাকিস্তান, বেলুচিস্তান) বন্দর নির্মাণ করে ভারত মহাসাগরে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চাইছে, ঠিক তখনই ভারত চাহবাহার বন্দরটি নির্মাণ করছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের একটি সামরিক দিকও রয়েছে। ওবামা আমলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। ওই চুক্তি-বলে উভয় দেশ তার নিজ দেশের সামরিক ঘাঁটি অন্য দেশকে ব্যবহার করতে দেবে। এর অর্থ হচ্ছে আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা পারসীয় অঞ্চলের সংকটে যুক্তরাষ্ট্র যদি সামরিকভাবে জড়িত হয়, তাহলে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী রিফুয়েলিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। অতীতে চন্দ্র শেখর সরকার (নভেম্বর ১৯৯০-জুন ১৯৯১) যুক্তরাষ্ট্রকে এই অধিকার দিয়েছিল। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তিও রয়েছে। ২০০৮ সালে বিগত ইউপিএ সরকার চুক্তিটি স্বাক্ষর করলেও, মোদি সরকারের সময় এটি অনুমোদিত হয়। এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতে একটি পারমাণবিক চুল্লি বসাবে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হবে। একটি বীমা তহবিলও গঠন করা হবে। ওবামা আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে ভারত ছোট আকারের ‘সাভেন মিনি’ নামে ছোট ড্রোন তৈরি করবে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তি-বলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন টাটা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ভারতে এফ-১৬ বিমান নির্মাণ করবে।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত অংশীদার’। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগর ক্রমান্বয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে, তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই স্বার্থকে আঘাত করা এবং চীনা নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকেও অন্যতম পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘টিকফা’ চুক্তি করেছে। এখন ‘আকসা’ চুক্তি করতে চাইছে। ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একসঙ্গে কাজ করছে। তথাকথিত এই ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ এর বাইরে থাকবে না। ট্রাম্পের ভারত সফর নিঃসন্দেহে মোদির জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। কাশ্মীরের পাশাপাশি ভারতে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মোদিবিরোধী জনমত যখন শক্তিশালী হচ্ছে, কিংবা দিল্লির নির্বাচনে আম আদমি পার্টির তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকাতে বিজেপির ব্যর্থতা যখন প্রকট হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই ট্রাম্প ভারত সফরে এলেন। একটি বাণিজ্য চুক্তির কথা থাকলেও, তা শেষ পর্যন্ত আর হচ্ছে না। ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থাও এখন নিম্নগামী। এমনি এক পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের এ সফর মোদির অবস্থানকে কতটুকু শক্তিশালী করবে সেটাই দেখার বিষয়।( সৌজন্যে:দেশরূপান্তর)