বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা কেন
কামরুল হাসান মামুন:বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-সুনাম নির্ভর করে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মানের ওপর। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মান নির্ভর করে তাদের কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্ত করা হয় তার ওপর। যেমন শিক্ষকের মান অনেকাংশেই নির্ভর করে শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রমোশন নীতিমালার ওপর। শিক্ষার্থীদের আবার দুইভাগে ভাগ করা যায় ১. ‘ইনপুট’, অর্থাৎ যারা কেবল ভর্তি হলো, ২. ‘আউটপুট’, অর্থাৎ যারা পাস করে বের হলো। আউটপুটের মান কেমন হবে তা শিক্ষকের মান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর মানের ওপর যেমন নির্ভর করে, ঠিক তেমনি নির্ভর করে ইনপুট হওয়া শিক্ষার্থীর মানের ওপরও। শিক্ষার্থী হলো ‘উপকরণ’ আর শিক্ষক হলেন ‘কারিগর’। কেমব্রিজ, এমআইটি, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে বিশ্বসেরা এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম এরা সেরা ইনপুট পায়। সেই সেরা ইনপুট পাওয়ার জন্য এরা সেরা বাছাই পদ্ধতিও অনুসরণ করে। শিক্ষার্থী নির্বাচনের পদ্ধতি চিরদিন একই থেকে যায়নি বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আলোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে ভালো থেকে আরও ভালো হচ্ছে।
শিক্ষার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি কি কোনো কিছুর সঙ্গে আপোস করা যায়? শিক্ষার্থী গরিব, কিংবা দুর্ভোগে রয়েছে একথা বিবেচনায় নিয়ে কি কোনো ভর্তি পদ্ধতির মান নামানো যাবে? মান অক্ষুণ্ন রেখে যদি কিছু করা যায় সেটা সব সময়ই চেষ্টা করা উচিত। গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক অনুদান দেওয়া যেতে পারে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মানের সঙ্গে আপোস নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের ব্যাপারটি অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেন। এর আগে এই চিন্তাটি প্রথম তুলে ধরেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হয়। এটা তো নিশ্চয়ই কিছুটা দুর্ভোগের এবং একই সঙ্গে আর্থিক খরচের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপারটিকে যেভাবে দেখা হচ্ছে আসলে কি বিষয়টা সেরকম? যদি আমরা এটাকে দুর্ভোগ হিসেবে দেখি তাহলেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাই কি তার সমাধান?
এখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী বছর থেকে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। প্রথমেই আসল কথাটা বলে ফেলি। যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় তাহলে এটা একটা ‘বিপর্যয়কর’ সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। অনেক কারণ আছে। আমাদের ভিসিরা কি সত্যি শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নাকি ওপরের মানুষকে খুশি করতে রাজি হয়েছেন? আমরা কি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মতো এত বিশাল কর্মযজ্ঞ সাধনের জন্য তৈরি? এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, হাজার হাজার শিক্ষক। কারা প্রশ্ন করবেন? কারা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন? কারা পরীক্ষার দিন ইনভিজিলেশনসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবেন? এমনিতেই বর্তমানে ডিনের অধীনে সংশ্লিষ্ট অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা হয়। প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সব কাজে সাধারণত ডিন যেই দলের ভোটে জিতেছেন মনে করেন তাদেরই দায়িত্ব দেন। এখন যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারদলীয় শিক্ষকদেরই প্রধানত এইসব দায়িত্ব দেওয়া হবে। যখন এমনটাই শতভাগ হবে তখন শতভাগ নিশ্চিত যে তা বিপর্যয়কর হবেই। আমরা ইতিমধ্যেই জানি, মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল-কলেজের যে কারিকুলাম ও অন্যান্য কাজের কমিটি করা হয় সেগুলোতে কেবল সরকারদলীয় শিক্ষকরাই সুযোগ পান। আর তার ফল তো আমরা দেখছিই। আমার ধারণা ছাত্রদের দুর্ভোগ পুঁজি করে এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নামে গোটা বিষয়টাকে রাজনৈতিক চক্করের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হবে যেখানে কেবল সরকারদলীয় শিক্ষক আর আমলারা কাজটি সম্পন্ন করবেন।
যদি শিক্ষকরা অনেক চিন্তাভাবনা করে নিচ থেকে আলোচনা করে ওপরে যেতেন তাহলে একরকম হতো। এখন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মতো হয়ে গিয়েছে। আমাদের আরও তলিয়ে ভাবা উচিত। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে একজন ছাত্র তখন অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ভর্তি পরীক্ষা দেবে। ওই দিন কোনো কারণে শরীর খারাপ থাকলে বা অন্য কোনো কারণে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা দিতে না পারলে বা পরীক্ষা খারাপ হলে ওই ছাত্রের ভবিষ্যৎ কী? আলাদা আলাদা পরীক্ষা হলে ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ বাড়ে। এক জায়গায় কোনো কারণে খারাপ হলেও অন্য জায়গায় ভালো করার সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকে। এতে কি মানসিক ভোগান্তি অনেক কমে না? তাছাড়া এত বড় কলেবরে পরীক্ষা নেওয়ার মতো সক্ষমতা কি আমাদের আছে? এর নিয়ন্ত্রণে কে থাকবে? বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কার কি রোল থাকবে? কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন? আমার তো ধারণা সমন্বিত পরীক্ষার ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে দরকষাকষি বাড়বে এবং এতে পরীক্ষার মান কমার ও প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে এবং প্রশ্নফাঁস হলে এর ক্ষতির দিকটা কী ব্যাপক হবে ভেবে দেখেছেন? ইউজিসি হলো দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। মনে আছে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে ইউজিসির কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন? ইউজিসির সদস্যদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির খবর মাঝে মাঝেই পাই। শোনা যায় যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নামে ছাত্রছাত্রীদের থেকে এ বছর ৪ কোটি টাকা লুট করেছে ইউজিসি। ১০০০ টাকা করে আবেদন ফি নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেয়নি। আদালতে রিট হলে টাকা ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সবার আইডি ব্লক করে দেয় ইউজিসির নেতৃত্বে হওয়া পরীক্ষা কমিটি। আর আমরা তাদের নেতৃত্বেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা ভাবছি? এছাড়া সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শ্রেণিবিভাজনের প্রশ্নটি আরও প্রকট হয়ে উঠবে। অলিখিতভাবেই ছাত্রদের প্রথম পছন্দের জায়গা দ্বিতীয় পছন্দের জায়গা ইত্যাদির একটি ক্রম তৈরি হয়ে যাবে এবং এর ফলে সমাজে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।অনেকেই বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই তো সমন্বিত পরীক্ষা নেওয়া হয় যেমন স্যাট পরীক্ষা। কথা কিছুটা সত্য। তবে এই পরীক্ষা কারা নেন? এটা কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেডারেশন বা ইউজিসির মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেয়? না। এই পরীক্ষা নেয় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। এর ফলাফলের ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া বা না নেওয়ার মধ্যে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনেকগুলো কম্পোনেন্টের মধ্যে স্যাটের ফলাফল কেবল ছোট একটি কম্পোনেন্ট। কারও স্যাটে ভালো ফলাফল সত্ত্বেও তাকে ভর্তি না করে তার চেয়ে খারাপ রেজাল্ট করা কাউকে নিলে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। স্যাটের ফলাফলের সঙ্গে আছে শিক্ষকের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার, আছে ‘পারপাস অফ স্টাডি’ শিরোনামে একটি রচনা লেখা ইত্যাদি। এগুলোর সবকিছু সমন্বয় করলে একজন শিক্ষার্থীর সত্যিকারের পোটেনশিয়াল বের হয়ে আসে। তাই শুধু বিদেশের ভালো পদ্ধতির উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই। ওরা শিক্ষায় জিডিপির ৬% বরাদ্দ দিয়ে আগে যোগ্যতাসম্পন্ন সৎ ও সুন্দর মনের মানুষ তৈরি করেছে। কিন্তু তারাও হঠাৎ কোনো সিস্টেমের পরিবর্তন করে না। বলা হচ্ছে এক দুই বছর চললে বুঝতে পারব কোথায় সমস্যা তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে এইরকম খেলা কি ঠিক? বরং এইসব নিয়ে বিশদ আলোচনা ও গবেষণা করে তারপর ধীরে ধীরে সিদ্ধান্তের পূর্ণ বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে।
কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একটি অভিন্ন নীতিমালা তৈরির দুরভিসন্ধিমূলক এক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। শিক্ষকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা সেটা বাস্তবায়নের চিন্তা থেকে সরে এসেছেন। এখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার খেলা শুরু। আমরা কি বুঝতে পারি কেন তারা এটি চাচ্ছে? এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার অংশ হতে চায়। আর এটি তাদের হাতে যাওয়া মানেই আমলাদের হাতে যাওয়া। তখন এর ফল কী ভয়াবহ হবে তা কি আমরা আঁচ করতে পারি? আমরা মঞ্জুরি কমিশনের সক্ষমতা আমরা জানি। এটি দুর্নীতির আখড়া বলে পরিচিত। কোনোভাবে এইসব কাজ এদের হাতে চলে গেলে গোটা ভর্তি প্রক্রিয়াটা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা করছি। ইতিমধ্যে কমিশনের কর্মকর্তা ও সদস্যদের নানা অপকর্ম সম্বন্ধে আমরা জানি। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগও আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বা ছাত্র ভর্তির প্রক্রিয়া কেমন হবে সেটা কি সরকার, ইউজিসি আর আমাদের ভিসিরা নেবেন? এরা কেউ শিক্ষাবিদ নন। এরা শিক্ষা নিয়ে ভাবেন না। অন্তত সাধারণ মানুষ মনে করে তারা এই কাজের যোগ্য ব্যক্তি নন। একেবারেই নন। এইসব প্রক্রিয়া উচ্চ পর্যায়ের কোনো এক মিটিং-এ সিদ্ধান্তের বিষয়ও না। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলে বোঝা উচিত এর জন্য একটি comprehensive home work হওয়া উচিত। এটা নিচ থেকে আলোচনার মাধ্যমে পরিশোধিত হতে হতে ওপরে গিয়ে উচ্চ পর্যায়ের মিটিং-এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। ওপর থেকে নাজিল হওয়া দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে এর ফল কখনো ভালো হবে না।
লেখক
অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়( সৌজন্যে:দেশরূপান্তরর)