মেঘনা সংকটাপন্ন
প্রান্তডেস্ক: মেঘনা নদীকে সংকটাপন্ন ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। রাজধানীবাসীর খাবার পানির উৎস হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর এ সংক্রান্ত ঘোষণার প্রস্তাব পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হলে নদীতীরে পরিবেশ দূষণকারী কলকারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেমন সহজ হবে তেমনি নতুন কলকারখানা স্থাপন বন্ধ করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান শিল্পকারখানা ও প্রকল্প স্থানান্তর করা যাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীর পানি আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। রাজধানীর কাছাকাছি মিঠা পানির নদী হিসাবে মেঘনা এখনো ভালো আছে। এটাকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কোনোভাবেই মেঘনার পানি নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। এ পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্দেশ্যে হচ্ছে সবাইকে সতর্ক করা। নদীর পানি পান উপযোগী রাখা কতটা জরুরি আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য সবাইকে ভুগতে হচ্ছে। তাই সংকটাপন্ন ঘোষণা করে মেঘনা নদী রক্ষার জন্য অগ্রিম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পুরো নদীকে সংকটাপন্ন ঘোষণা না করে চার জেলার ছয়টি স্থানকে সংকটাপন্ন ঘোষণা করা হচ্ছে। মোট ১১৯ বর্গকিলোমিটার সংকটাপন্ন এলাকার মধ্যে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা জেলা। এসব জেলার সংবেদনশীল স্থানকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণার প্রজ্ঞাপনের খসড়া করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই সংকটাপন্ন এলাকার পরিবেশ ব্যবস্থাপনার নির্দেশিকার একটি গাইডলাইনও করা হয়েছে।
মেঘনা নদীর যে অংশটিকে সংকটাপন্ন ঘোষণা করা হবে সেগুলো হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ উপজেলা, নরসিংদী জেলার সদর উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা এবং কুমিল্লা জেলার হোমনা ও মেঘনা উপজেলা। এসব উপজেলার চর ভাসানী, চর দিঘালদি, নুনেরটেক, কালাপাহাড়িয়া ও নজরপুরকে সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূমি জরিপের সিএস ও আরএস ম্যাপের ভিত্তিতে ইসিএ এলাকার চৌহদ্দি নির্ধারণ করা হয়েছে। কনক্রিটের পিলার দিয়ে ইসিএ ঘোষিত নদী চিহ্নিত করা হবে। এসব সংবেদনশীল এলাকার মোট ১১৯ বর্গকিলোমিটার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এসব এলাকায় প্রচুর শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। কারখানা থেকে নির্গত তরল-কঠিন-বায়বীয় বর্জ্য মেঘনা নদীর পানি, মাটি ও বাতাসকে দূষিত করছে। এসব এলাকায় বাড়িঘর তৈরি করার জন্য অবাধে নদী তীরবর্তী জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। স্থাপন করা হচ্ছে ইটভাটা। উজানে প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর পানির লবণাক্ততাও বেড়ে গেছে।
প্রকল্পের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য মেঘনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকায় ৩০ ধরনের মাছের প্রজাতি, বিপন্ন তালিকাভুক্ত দুই ধরনের কচ্ছপ যা ভারতীয় কাটা কাছিম নামে পরিচিত, দক্ষিণ এশীয় শুশুক এবং দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। এগুলো হুমকির মুখে। এসব বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি রক্ষা করার জন্য মেঘনা নদীর প্রস্তাবিত অংশকে জরুরিভাবে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা দরকার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক ড. ফাহমিদা খানম বলেন, আমরা সরকারের সংস্থা ও বিভাগগুলোকে এ বিষয়টি জানিয়ে দেব। এরপর মেঘনা নদীর পানির দূষণ হবে এমন কোনো কর্মকান্ডের অনুমোদনের আগে তারা যেন সতর্ক হয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কোনোভাবেই মেঘনা নীর পানিকে ঢাকা আশপাশের নদীর মতো দূষিত হতে দেওয়া যাবে না। এজন্য ওই নদীর পাড়ে শিল্পকারখানা বা অন্য কোনো কর্মকান্ডের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। নদীর পানি যেন দূষিত না হয় সেজন্যই উদ্যোগ নেওয়া।
সংকটাপন্ন এলাকার ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দেশিকা তৈরি করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ নির্দেশিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, কীভাবে সংকটাপন্ন এলাকা পরিচালনা করে পানির গুণগত মান একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা যাবে তা এ নির্দেশিকায় বলা হয়েছে।
মেঘনা নদী রক্ষার জন্য বাফার এলাকা প্রতিষ্ঠা করা হবে। বাফার অঞ্চল মূলত জলীয় ও স্থলজ পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে নির্ধারণ করা হয়। যেখানে উভয় অঞ্চল থেকে জীবজন্তু, প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি আসবে। এ এলাকা প্রাণী, মাছ ও শামুকসহ অন্যান্য প্রাণী ব্যবহার করবে। এর ওপর নির্ভর করে বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের সমবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনার জন্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ইসিএ দল গঠন করা হবে। এই দলগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট সব কাজে সম্পৃক্ত থাকবে। তাদের তদারকিতে প্রকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন পেশার মানুষদের অংশগ্রহণে তৃণমূল পর্যায়ে দল গঠন হবে। মেঘনা নদীর ইসিএ ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য জেলা প্রশাসক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ঢাকা ওয়াসা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে একটি ভ্রাম্যমাণ তত্ত্বাবধায়ক দল থাকবে। এই দলের তাৎক্ষণিক পরিবেশগত পরিবীক্ষণ ও আইন প্রয়োগের ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার থাকবে।
জরিপে দেখা গেছে, উজানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর পানির লবণাক্ততাও বেড়ে গেছে। তাই পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ না করে কোনো প্রয়োজনে মেঘনা নদী থেকে পানি সংগ্রহ বা প্রত্যাহার করা যাবে না। প্রয়োজনমতো ড্রেজিং করে পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা হবে। মেঘনা নদীসংশ্লিষ্ট এলাকা দূষণমুক্ত রাখতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট কাজ জোরদার করা হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান শিল্পকারখানা ও প্রকল্প স্থানান্তর করতে হবে। নদী তীরবর্তী এলাকায় কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হবে। নদী তীরের বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান তরল বর্জ্য ও কঠিন বর্জ্য নির্গমন বন্ধ করতে হবে। আইনভঙ্গ করে কোনো প্রকার স্থলজ বা জলজ পরিবেশে বসবাসকারী বন্যপ্রাণী, পাখি এবং মাছসহ অন্যান্য প্রাণী যেন শিকার না হয় সেজন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আইন প্রয়োগে আরও বেশি সতর্ক হবেন।
মেঘনা প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের নদী। বাংলাদেশের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখানে কার্প জাতীয় মাছ অর্থাৎ রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ এসব মাছ ডিম ছাড়ে এবং নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয়। মেঘনা স্থানীয়ভাবে বিপন্ন ডলফিনের আশ্রয়স্থল। কিন্তু পানি দূষণের জন্য ডলফিনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। মেঘনা নদীর কোনো একটা অংশকে ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. লুৎফুল হাসান বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর এটা ইসিএ ঘোষণা করছে করুক, কিন্তু এতে থেমে থাকলে চলবে না। নদীর পানি ও নদীকে বাঁচাতে অবৈধ দখলদার, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার বিষয়ে কঠোর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, এছাড়া দেশের স্বার্থে সচেতনতাও সৃষ্টির দরকার আছে। অবাধ পলিথিন ও প্লাস্টিক যেন নদীতে গিয়ে না পড়ে সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশে, মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের স্বার্থে নদী বাঁচানো প্রয়োজন। এটা রক্ষার দায়িত্বও সবার।
মেঘনা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী। আসামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়ে বরাক নদী সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বিভক্ত হয়েছে। এরপর সিলেট জেলার ওপর দিয়ে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ হয়ে কালনি নামে কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে। ভৈরব বাজারের কাছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে। দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে চাঁদপুরের কাছে পদ্মায় মিলে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা হয়ে মেঘনা নামেই বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।(সৌজন্যে:দেশ রূপান্তর)